ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ কি ইসলামিক রিপাবলিক!

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশ কি ইসলামিক রিপাবলিক!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম কি ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ? ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশে’র শিক্ষামন্ত্রী কি নুরুল ইসলাম নাহিদ? অন্তত মঙ্গলবার রাজধানীতে শেষ হওয়া বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৯টি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ক ‘ই-নাইন’ ফোরামের সম্মেলন ইস্যুতে দেশী-বিদেশী প্রতিনিধিদের কাছে পাঠানো মেইল বার্তা বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন তথ্যই দিচ্ছে। নজরে আসার পরে আয়োজকরা রহস্যজনক এ ভুল সংশোধন করলেও তোলপাড় চলছে পুরো ঘটনা নিয়ে। ঘটনায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রগতিশীল বিশিষ্ট নাগরিকদের মাঝে। এদিকে তিনদিনের এ সম্মেলন মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। বিশিষ্টজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ই-নাইনের আয়োজক ও চেয়ারম্যান হওয়া গর্বের। তবে কারা ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ বলে প্রচার করেছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরী। যদিও ঘটনার দায় নিচ্ছে না কেউ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউনেস্কো কমিশন বাংলাদেশের কেউ ঘটনার দায় নিতে রাজি নন। ঘটনাটি জানেন না বলে দাবি করছেন অধিকাংশ কর্মকর্তাই। আবার কেউ কেউ বলছেন, এ ভুল আমাদের দেশের কারো নয়। এ কাজ করেছে ই-নাইন সেক্রেটারিয়েট। যেটা অবস্থিত ইউনেস্কোর হেড কোয়ার্টারে। প্যারিসে অবস্থিত ই-নাইনের সেক্রেটারিয়েট প্রথমে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ তথ্য বললেও পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়ে সংশোধন করে মেইল পাঠিয়েছে। তিনদিনের সম্মেলনের শেষের দিন মঙ্গলবার ফোরামের চেয়ারম্যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ই-নাইন সদস্য রাষ্ট্রসমূহের শিক্ষা বিষয়ক লক্ষ্য বাস্তবায়নে ফোরামের সদস্য রাষ্ট্র ও ইউনেস্কোর যৌথ প্রয়াস টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ঢাকা সম্মেলনে ই-নাইন সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে একটি এ্যাকশন প্লান গ্রহণ করার মাধ্যমে সহযোগিতার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করেছে। সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তৃতায় একথা বলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। মন্ত্রী বলেন, ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিনে সর্বসম্মতিক্রমে ই-নাইন চেয়ার, সদস্য রাষ্ট্র ও ইউনেস্কোর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট টার্মস্ অব রেফারেন্স গৃহীত হয়েছে। এর ফলে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি-৪ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, ফোরামের সদস্য দেশগুলোর কমন সমস্যা, যেমন বয়স্ক শিক্ষার হার বাড়ানো, মেয়ে শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসা, ঝরে পড়া কমানো এবং মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে আরও সুনির্দিষ্ট ও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মন্ত্রী আরও বলেন, এ ফোরামের নতুন সভাপতি হিসেবে এর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তিনি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সকল দেশের সহযোগিতা কামনা করেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী উপেন্দ্র কিশোর, ইউনেস্কো প্রতিনিধি জর্ডান নাইডু এবং অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। তারা সফলভাবে এ সম্মেলন আয়োজনের জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানান এবং এ সম্মেলন আয়োজনে সার্বিক সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানান। তারা এ সম্মেলনকে ই-নাইন ফোরামের অন্যতম সফল সম্মেলন বলে উল্লেখ করেন। এদিকে সম্মেলন ভালভাবে শেষ হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করলেও সম্মেলন শুরুর আগে বিভিন্ন দেশের পার্টিসিপেন্টদের কাছে বাংলাদেশের নাম সম্পর্কে মেইলে পাঠানো বিকৃত তথ্য সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনের অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেছে, শুরু আগে সকল দেশের প্রতিনিধির কাছে সম্মেলন সম্পর্কে নানা তথ্য জানানো হয় ই-মেইলে। যেখানে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে ছিল কোন দেশ থেকে কারা কারা সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। এই তথ্যেই ছিল বিকৃতি। সকল দেশের নাম লিখে তার নিচে সেই দেশের শিক্ষামন্ত্রীর নামসহ অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের নাম লেখা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ অন্যদের নামের ওপরে লেখা হয়, ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ।’ এরপরই তা নজরে আসে অনেকের। অংশগ্রহণকারীদের থেকে বাংলাদেশের আয়োজকদের কাছে অভিযোগ করা হলে দ্রুত কয়েক মিনিটের মধ্যে তা সংশোধন করে আবার মেইল পাঠানো হয়। মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইউনেস্কো কমিশনে গেলে কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এক কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে আয়োজক কমিটির সদস্যদের নাম জানতে চাইলে তিনি সম্মেলনে কাজের ব্যস্ততায় আছেন বলে জানান। সার্বিক বিষয়ে কমিশনের মহাসচিব মোঃ মঞ্জুর হোসেনের (যুগ্ম সচিব) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন ওই কর্মকর্তা। এরপর মঞ্জুর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার বিষয়টি জানা নেই। কোথা থেকে মেইল গেছে? কোথা থেকে সংশোধন হলো সকল তথ্য জানা গেলে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এরপর তিনি ইউনেস্কোর সেক্রেটারিয়েট থেকে কাজ করা হচ্ছে বলে তার ধারণা বলে জানান। একই সঙ্গে বলেন, মন্ত্রণালয়ে কথা বলে দেখতে পারেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে কোন কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। তবে সম্মেলনের জন্য গঠিত একটি কমিটির সমন্বয়ক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এটা আমাদের ভুল নয়। এখান থেকে নয়। এ কাজ হয়েছে ইউনেস্কো সেক্রেটারিয়েট থেকে। তারাই মেইল পাঠিয়েছে। পরে আমার কাছে অভিযোগ আসলে আমি বিষয়টি ইউনেস্কোর কাছে জানাই। এরপর তারা সংশোধন করে আবার মেইল পাঠিয়েছে। কাজ করেছে ই-নাইন সেক্রেটারিয়েট। যেটা অবস্থিত ইউনেস্কোর হেড কোয়ার্টারে। প্যারিসে অবস্থিত ই-নাইনের সেক্রেটারিয়েট প্রথমে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ তথ্য বললেও পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়ে সংশোধন করে মেইল পাঠিয়েছে। এদিকে পাঠ্যবইয়ের মৌলবাদী চেহারা দানের মতো এখানেও সরল ব্যাখ্যা দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। কয়েক প্রতিনিধি বলেছেন, ঘটনা সরকারীভাবে তদন্ত হওয়া জরুরী। দেশে বা বিদেশে হোক এই ঘটনার পেছনের রহস্য বের করা জরুরী। উল্লেখ্য, গতবারের চেয়ারপার্সন পাকিস্তানের শিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বালিঘ-উর-রহমানের পর এ সম্মেলনের মাধ্যমে ই-নাইনের নতুন চেয়ারপার্সন হয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ই-৯ এর জন্ম দিল্লীতে ১৯৯৩ সালে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৯টি উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ শিক্ষা বিষয়ক লক্ষ্যসমূহ নিয়ে এই সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে টেকসই উন্নয়নের জন্য নতুন বৈশ্বিক ‘এডুকেশন ২০৩০’ এজেন্ডার প্রেক্ষাপটে ই-৯ উত্তর-দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার একটি সাধারণ প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। ই-৯ ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, চীন, মিসর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া এবং পাকিস্তান।
×