ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:২০, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

নবম অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে পদায়ন (গত বুধবারের পর) এই বক্তৃতায় তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। অন্যদিকে কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে বন্ধুত্বের হাতও এগিয়ে দিলেন। তিনি মোট ৪টি দাবি উপস্থাপন করলেন : ১. অবিলম্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর; ২. যেসব সেনারা রাস্তাঘাটে আইনশৃঙ্খলা বজায়ের জন্য বেয়নেট উঁচিয়ে আছে অথবা গুলি করছে তাদের সেখান থেকে প্রত্যাহার করে ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া; ৩. এই ক’দিন যে নিরস্ত্র নিরীহ বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যার বিচার করে দোষীদের শাস্তি প্রদান; এবং ৪. জাতীয় পরিষদকে তৎক্ষণাৎ আহ্বান করে সংবিধান রচনার কাজ সম্পন্ন করা। অনেক মহলেই ধারণা করা হয় যে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে এককভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে দেখা করে আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তারা এ রকম কোন ঘোষণা সমর্থন করেন না। অন্যদিকে ছাত্র ও যুব মহলে ব্যাপক চাপ ছিল এ রকম ঘোষণা প্রদান করার পক্ষে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণা ঠিক দিলেন না কিন্তু একই সঙ্গে পরোক্ষভাবে ঘোষণা দিলেনও বটে। তিনি জেনারেল ইয়াহিয়াকে ঢাকায় এসে আলোচনা করতে আহ্বান জানালেন এবং ঘোষণাও দিলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ পাকিস্তান সরকার ৬ মার্চে প্রাদেশিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে আরও পরিবর্তন নিয়ে আসলেন। নিহায়ত ভদ্রলোক এডমিরাল আহসান পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদায় হলেন। বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানে লাট নিযুক্ত হলেন। জনরোষকে সম্মান করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বদরুদ্দিন সিদ্দিকী তাকে শপথ দিতে বিরত থাকলেন। ১৫ মার্চে অবশেষে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ঢাকায় আসলেন এবং পরের দিনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার একাকী বৈঠক হলো। ১৭ মার্চে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তাদের উপদেষ্টাদেরসহ বৈঠক হলো। অন্যদিকে এই সময়ে দেখা গেল যে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সবচেয়ে বড় আসর বসল। একসঙ্গে ২২ জন জেনারেল এর আগে কোনদিন পূর্ব পাকিস্তানে সমবেত হননি। জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে জিওসি হন এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো যে, তিনি কিভাবে ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন তার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। তিনি রাতারাতি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ প্রস্তুত করলেন। ১৯ মার্চে জয়দেবপুরের সেনা নেতা যিনি ছিলেন বাঙালী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো এবং জয়দেবপুরের দায়িত্বে রইলেন বাঙালী মেজর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ। সেই দিন আবার রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে প্রায় ৯০ মিনিটের বৈঠক হলো। তাদের এই বৈঠকে কোন উপদেষ্টা ছিলেন না তবে তারা ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের শেষে পুনরায় আলোচনায় বসলেন। পরবর্তী কয়েকদিন ঢাকায় দেশের সব রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ খুবই ব্যস্ত সময় কাটালেন। রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া এবং বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টাসহ ৪র্থ দফায় তাদের বৈঠক হলো। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল নেতাদের সঙ্গে স্বতন্ত্র এবং যৌথ বৈঠক করলেন। এসব অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা, ন্যাপের ওয়ালী খান এবং জামাতুল ওলামায়ে ইসলামের মুফতি মোহাম্মদ মাহমুদ। জনাব ভুট্টোও তার উপদেষ্টাদের নিয়ে ঢাকায় হাজির হলেন এবং দাবি করলেন যে, আওয়ামী লীগ, পিপিপি এবং সেনা নেতৃত্বের মধ্যে বৈঠক হতে হবে। ২২ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া ঘোষণা দিলেন, ২৫ তারিখে যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল সেইটি অনির্দিষ্টকালের জন্য আবার স্থগিত হলো। ২৩ এবং ২৪ মার্চে আওয়ামী লীগ এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের দফায় দফায় বৈঠক হলো। আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ এবং ড. কামাল হোসেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম. এম. আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ. আর. কর্লেনিয়াস, রাষ্ট্রপতির পিএসও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা এবং রাষ্ট্রপতির আরেক উপদেষ্টা কর্নেল হাসান। ২৪ তারিখে সকালে-বিকালে দু’বারই বৈঠক হলো। ২৫ মার্চে প্রথম লগ্নে জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক করলেন পিপিপি নেতা জে. এ. রহিম এবং মোস্তফা খর। মিয়া মমতাজ দৌলতানা জানিয়ে দিলেন, তারা কোন বিভক্ত জাতীয় পরিষদের বৈঠক চান না। ভুট্টো মন্তব্য করলেন, ৬ দফা এমন স্বায়ত্তশাসন দেবে যে, সেটা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। ২৫ তারিখে সবাই রইলেন অপেক্ষায় কখন রাষ্ট্রপতি সমঝোতা ঘোষণা করবেন, কখন জেনারেল ইয়াহিয়ার তরফ থেকে আলোচিত বিষয়ে ইঙ্গিত আসবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এসেছিলেন তারা একে একে সবাই চলে গেলেন। বাজেনজো, দৌলতানা, ওয়ালী খান সকলে চলে গেলেন। জনশ্রুতিতে জানা গেল, সন্ধ্যা ৮টায় জেনারেল ইয়াহিয়া, এম. এম. আহমেদ এবং তাদের পুরোটি টিম পশ্চিম পাকিস্তানের পথে উড়াল দিয়েছেন। তখনই সন্দেহ হলো যে, সেনাবাহিনী অপারেশনে যাবে এবং গুলি ছোড়া এবং ধরপাকড় শুরু হবে। চলবে...
×