ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

প্যারাডাইম শিফট

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

প্যারাডাইম শিফট

‘প্যারাডাইম শিফট’ শব্দটার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। বিভিন্ন স্থানে আমরা এটা প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু এর গভীর মর্মার্থ কতজন বুঝতে পারেন? শাব্দিক অর্থে না গিয়ে, আমি মানুষের ইফেক্টিভনেস বোঝাতে গিয়ে এই শব্দটার ওপর জোর দিচ্ছি। তাই ড. স্টিফেন কোভের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যখন প্যারাডাইম শিফট নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আমার মনে হয়েছে এটা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, তাদের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে ব্রেন থেকে, দীর্ঘদিনের ধ্যান-ধারণা থেকে। এর বাইরে তাদের যেতে খুব কষ্ট হয়। খুব টিপিক্যাল কিছু মনস্তত্ত্ব¡ রয়েছে এদের। একটি ছেলেকে কোন মেয়ের সঙ্গে রিক্সায় দেখল, অমনি ভাবতে শুরু করলÑ ‘হুম, বুঝেছি! এই তাহলে খবর!’ কিন্তু কী যে সে বুঝেছে, সেটা তার গ-ির পরিধিতেই সীমাবদ্ধ। সরকারের কোন একটা ভাল কাজের প্রশংসা করলেন। অমনি তিনি ভাবতে শুরু করলেন, ‘কত টাকা পেয়েছ হে!’ বিরোধী দলের কোন কিছুর প্রশংসা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর প্রশ্ন- ‘ভাল একটা ধান্দা পেয়েছে নিশ্চয়ই!’ এগুলো আগের দিনের বাংলা সিনেমাতেও দেখান হতো এবং এগুলো সমাজে রয়েছে। বাঙালীদের চিন্তা-ভাবনাগুলো খুবই সেকেলে। সেই ছোট্ট উঠোনে আটকে যাওয়া এক ফালি চাঁদের মতো। মানুষ যে এর ভেতর চাঁদে গিয়ে অন্য গ্রহে চলে যাচ্ছে, সেটা খবরের কাগজে পড়লেও বিশ্বাস করতে কষ্ট। কিংবা চিন্তাটাকে ততদূর নিতে যে সাহস লাগে সেটা হয়ে উঠছে না। তবে বর্তমান সময়ের অনেক ছেলেমেয়ে ঠিক আগের মতো করে ভাবছে না। তারা চিন্তা-চেতনায় অনেক অগ্রসর হয়েছে। চারদিকে নানা কিছুর সঙ্গে বেড়ে উঠছে, যার অনেক কিছুই ইতিবাচক। তবে চিন্তা-চেতনায় কতটা দূরে পৌঁছতে পারছে, সেটা এখনও দেখা হয়ে ওঠেনি আমার। ধরে নিচ্ছি তারাও নতুন ধারণাকে নিজের ভেতর নিতে পারে। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। চিন্তায় স্বাধীনতা আনতে পারে। প্যারাডাইমের শক্তি প্যারাডাইম শব্দটি এসেছে গ্রীক থেকে। এটা প্রথম দিকে বৈজ্ঞানিক শব্দ হিসেবে চালু হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা আমাদের প্রচলিত শব্দে ঢুকে যায়, যেখানে প্যারাডাইম বলতে কোন ধরনের মডেল, তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, ধারণা, দৃষ্টান্ত, কোন রেফারেন্সের ফ্রেমওয়ার্ক ইত্যাদি বিষয় বোঝানো হয়ে থাকে। খুব সাদামাটাভাবে দেখলে আমরা নিজেদের যে চোখে বা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখি (চোখের দেখা নয়) সেটাই হলো আমাদের প্যারাডাইম। এই দেখার অর্থ হলো- উপলব্ধি করা, বুঝতে পারা এবং সেটাকে ব্যাখ্যা করা। এর আরেকটি তাত্ত্বিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমনÑ আমরা যে ম্যাপ ব্যবহার করি, তার সঙ্গে প্যারাডাইমের একটা মিল রয়েছে। কোন একটি জায়গার ম্যাপ যদি আপনি হাতে নেন, তাহলে সেই ম্যাপটি দিয়ে কিন্তু আপনি সীমানা নির্ধারণ করতে পারেন না। ম্যাপ কখনই সীমানা নয়। ম্যাপ হলো সীমানা সংক্রান্ত একটি ফ্রেমওয়ার্ক। এর মাধ্যমে বিশেষ কিছু জিনিস আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। জায়গাটি দেখতে কেমন, তার চারপাশে কোন্ কোন্ শহর রয়েছে, তাদের আকার কেমন, আকৃতি কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। প্যারাডাইম বিষয়টিও ঠিক এমনি। এটা হলো অন্য যে কোন বিষয় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির একটি ফ্রেমওয়ার্ক। এটা দিয়ে একটি বিষয়কে আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। কিন্তু এই প্যারাডাইমটিই আসল বস্তু নয়। আপনি ভাবলেন, আমি মানুষটি ভাল। আপনার এই ভাবনাটাই হলো আপনার প্যারাডাইম। তার সঙ্গে প্রকৃত আমি ভাল কি মন্দ, তা নির্ণয় করা যাবে না। আপনার দৃষ্টিতে আমি ভালÑ শুধু এটুকুই বলা যাবে। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আপনি প্রথম কলকাতা শহরে গিয়েছেন। আপনি শহরে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করার জন্য একটি ম্যাপ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন। এর ফলে আপনি বিভিন্ন স্থানে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৌঁছে যেতে পারবেন। কিন্তু যদি বিষয়টা এমন হয় যে, আপনি যে ম্যাপটি নিয়ে গিয়েছেন সেটা আসলে কলকাতা শহরের ম্যাপ নয়, ওটা দিল্লী শহরের ম্যাপ; কিন্তু ভুল করে ছাপা হয়েছে ‘কলকাতা’ (এমন ভুল কিন্তু প্রেসে অনেক হয়ে থাকে)। একটি স্থান খুঁজে পেতে আপনার কেমন ঝক্কি হবে? আপনার মেজাজ তখন কেমন হবে? একটি ভুল ম্যাপ নিয়ে আপনি যত কষ্টই করুন না কেন, আপনি সব সময় ভুল ঠিকানায় পৌঁছে যাবেন। আপনার কষ্টের ফল হবে এই যে, ভুল ঠিকানায় আপনি দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছেন। আপনি আপনার এটিচিউট যত ইতিবাচক রাখেন, যত ভাবতে থাকেন- এটা সাময়িক, জয় একদিন হবেই, তাতেও কি আপনি সঠিক ঠিকানায় যেতে পারবেন? না পারবেন না। আপনি একটি অজানা শহরে হারানো মানুষের মতো ঠিকানা খুঁজতে থাকবেন এবং এখানে আপনার ব্যবহার কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির কোন কিছুতেই সমস্যা নেই; এর মূল সমস্যাটা হলো, আপনার হাতে রয়েছে একটি ভুল ম্যাপ। আপনার হাতে যদি থাকত কলকাতা শহরের সঠিক ম্যাপ এবং পথ চলতে যদি আপনি কোন বাধার মুখোমুখি হতেন, তখন ম্যাপটা আপনাকে কতই না সাহায্য করতে পারত। তাই প্রথম যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো একটি সঠিক ম্যাপ। আমাদের প্রত্যেকের মাথায় শ’ শ’ এমন ম্যাপ রয়েছে। জি, শয়ে শয়ে। তবে এই ম্যাপগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যাবে। প্রথমটি হলো- বিষয়গুলো আসলে যেমন, তার ম্যাপ। দ্বিতীয়টি হলো- বিষয়গুলো যেমন হওয়া উচিত ছিল, তার ম্যাপ। আমাদের মনের ভেতর যে ম্যাপটা আছে, আমরা সবকিছু সেই ম্যাপ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। আমরা কদাচিৎ জানতে চাই, ম্যাপটি কি সঠিক? এটা ভুল ম্যাপ নয়ত আবার? এমনকি, আমরা বেশিরভাগ সময় বুঝতেই পারি না যে, আমাদের কাছে একটি ভুল ম্যাপ রয়েছে। আমরা ধরে নেই, আমরা যেভাবে বিষয়টিকে দেখছি, বিষয়টি আসলেই তেমন; নয়ত তেমনটি হওয়া উচিত ছিল। আমরা মনে করি, আমাদের হাতে থাকা ম্যাপটাই সঠিক এবং সেই বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ সেই ম্যাপটির ওপরই নির্ভর করে। আমরা যেভাবে ভাবি এবং যেভাবে আচরণ করি, তার মূল ভিত্তিটাই হলো সেই ম্যাপ। এই একই কারণে একটি ছবিতে কোন মেয়েকে আপনার কাছে মনে হতে পারে ২৫ বছরের তরুণী; আবার কারও কাছে মনে হতে পারে ৭০ বছরের বৃদ্ধা। এটা নির্ভর করবে কে কিভাবে ওই ছবিটিকে দেখছেন। দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দু’জনই সঠিক। কিন্তু তাতে কি ছবিটি পাল্টে যাচ্ছে? কিংবা ছবির মানুষটি? আমরা যত বেশি আমাদের প্যারাডাইম, ম্যাপ কিংবা ধারণা সম্পর্কে সচেতন হব এবং আমাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রভাবিত হব, ততই সেই প্যারাডাইমগুলোর দায়িত্ব নিতে শিখব। আমরা সেগুলোকে অন্যদের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মিলিয়ে নিতে পারব। খোলা মনে অন্যদের মতবাদকে শুনতে শিখব এবং নিজের ভেতর সবকিছুর একটা বৃহত্তর ছবি আঁকতে পারব। আমরা যে আচরণ করি, নিজেকে যেভাবে পরিচালিত করি তার পুরোটাই করি আমাদের নিজস্ব এক ধরনের প্যারাডাইম থেকে। প্যারাডাইম শিফটের শক্তি আমাদের ভেতর যেমন প্যারাডাইম আছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে আরেকটি কথা খুব প্রচলিত, তা হলো ‘প্যারাডাইম শিফট’ এবং এটাকে অনেক সময় ‘আহা!’ মোমেন্টও বলা হয়। অর্থাৎ আপনি যখন কোন একটি বিষয়ের বড় একটি ছবি দেখতে পেলেন, কিংবা আগে যা দেখেননি সেটা দেখতে পেলেন তখন আপনার ভেতর যে অনুভূতি হয়, সেটা হলো- ‘আ-হা...!’ কোন একটি বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা যত শক্ত হবে, আপনার পরবর্তী জানাটা তত কঠিনভাবে একটা ‘আহা’ অনুভূতি দেবে। ধরুন, আপনি প্রাথমিকভাবে একজন মানুষকে ভেবেছিলেন চোর। কিন্তু পরবর্তী সময় কাছে এসে জানতে পারলেন, তার মতো ভাল মানুষটি আর হতে পারে না। তখন আপনার ভেতর দারুণ একটি ‘আহা’ কাজ করবে। এটা কঠিন একটি কাজ। এটা অনেকটা আপনার ভেতরে আলো জ্বালিয়ে দেয়ার মতো কঠিন কাজ। এটা আপনাকে আগের প্যারাডাইম থেকে সরিয়ে নতুন প্যারাডাইমে নিয়ে এসেছে। এটাকেই বলা হয়ে থাকে ‘প্যারাডাইম শিফট’। ‘প্যারাডাইম শিফট’ শব্দটি প্রথম চালু করেন বিখ্যাত লেখক থমাস কুন তার কালজয়ী বই ‘দি স্ট্রাকচার অব সায়েন্টিফিক রিভ্যুলুশন’-এ। কুন তার বইতে দেখিয়েছেন কিভাবে এই গ্রহের যাবতীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রথমেই মানুষের দীর্ঘদিনের ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। পুরনো ধ্যান-ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়েছে, যেগুলো পুরনো প্যারাডাইমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, নাকি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে- এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেগুলো আমাদের হাজার বছরের প্যারাডাইমকে ভেঙ্গেচুড়ে নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। আরেকটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মিসরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি বলেছিলেন, এই পৃথিবী হলো মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। দীর্ঘদিন মানুষ এটাই বিশ্বাস করেছে। কিন্তু পোল্যান্ডের গণিতবিদ নিকোলাস কুপার্নিকাস এসে করে দিলেন প্যারাডাইম শিফট। তিনি প্রমাণ করে দেখালেন, পৃথিবী নয়, সূর্য হলো এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। এর জন্য তাকে প্রচ- বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল এবং নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু তার এই মডেল অনেকের মাঝেই ভাবনাকে পরিবর্তন করে দেয়। মানুষ একই বিষয়কে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। এই পৃথিবীতে জার্ম (জীবাণু) তত্ত্ব আবিষ্কার হওয়ার আগে অসংখ্য নারী এবং শিশু জন্ম নেয়ার সময় মৃত্যুবরণ করত এবং কেউ বুঝতে পারত না, কেন এরা মারা যাচ্ছে। সামরিক যুদ্ধেও দেখা যেত, যত সৈন্য না সম্মুখযুদ্ধে মারা গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি সৈন্য মারা গেছে ছোটখাটো আঘাতে, কিংবা ক্ষতে। যেই মুহূর্তে জার্ম থিউরি আবিষ্কার হলো, সঙ্গে সঙ্গেই নতুন একটি প্যারাডাইমের জন্ম হলো। মানুষ বুঝতে পারল, কেন এভাবে রোগ-বালাইয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের কাছে নতুন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। এই ছোট নতুন জানার বিষয়টি ডাক্তারিবিদ্যায় নতুন দিগন্ত খুলে দিল। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটিও বিশাল এক প্যারাডাইম শিফটের ফসল। সহস্র বছর ধরে সরকার অর্থ ছিল রাজতন্ত্র। এর বাইরে কেউ কিছু ভাবতে পারত না। কিন্তু আমেরিকানরা ভিন্নভাবে ভাবতে পারল- তারা সরকার গঠন করল মানুষের প্রতিনিধিত্ব দিয়ে। তারা বলল, সরকার হবে জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। জন্ম হলো সাংবিধানিক গণতন্ত্রের। তারা নিশ্চিত করল মানুষের মুক্ত চিন্তা এবং মত প্রকাশকে। এটাই হলো বিশাল এক প্যারাডাইম শিফট। সব সময় প্যারাডাইম শিফট ইতিবাচক না-ও হতে পারে। তবে সেটা ইতিবাচক হোক, আর নেতিবাচক হোক এই পরিবর্তন আমাদের কোন পরিস্থিতি সম্পর্কে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়, ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়। আমরা এই পৃথিবীকে যেভাবে দেখছি, সেটাকে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়। আমাদের ব্যবহার, আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের ভেতর বেঁচে থাকা একটা প্যারাডাইম, তাই তার পরিবর্তন হলে আমাদের আচরণও পরিবর্তন হয়ে যায়। একটা ছোট গল্প দিয়ে আজকের মতো শেষ করি। গল্পটি স্টিফেন কোভের। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে প্রথম বাচ্যে লিখছি। নিউইয়র্কের সুন্দর একটি রবিবারের সকাল। অলস ভঙ্গিতে চলছে সাবওয়ে ট্রেন। যাত্রীরা শান্তভাবে বসে আছেন। কেউ খবরের কাগজ পড়ছেন, কেউ নিজের মতো ভাবনায় ডুবে আছেন, কেউ চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। চমৎকার শান্তিপূর্ণ একটি ট্রেনযাত্রা। হঠাৎ করেই ট্রেনের কামরায় প্রবেশ করলেন একজন পুরুষ এবং তার কয়েকটি ছেলেমেয়ে। তারা এত জোরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে শুরু করল যে, পুরো কামরার পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেল। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। লোকটি আমার পাশেই বসল এবং চোখ বন্ধ করে রাখল। ছেলেমেয়েগুলোর চিৎকার আরও বেড়ে গেল। তারা একে অপরের দিকে ঝগড়ার মতো করে কথা বলতে শুরু করল এবং কেউ কেউ অন্য যাত্রীদের পত্রিকা নিয়েও ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিল। খুবই বিরক্তিকর পরিবেশ। আর আমার পাশে বসে থাকা ভদ্রলোকটি তাদের কিছুই বলছিল না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ল। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, ভদ্রলোকটি তার সন্তানদের কিছু বলবে না। তিনি তাদের থামানোর কোন চেষ্টা করলেন না। ভদ্রলোক কোন দায়িত্ব পালন করছিলেন না এবং চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম, অন্য যাত্রীরাও খুব বিরক্ত; কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। সবাই মুখ বুজে বিষয়টি সহ্য করছে। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আমি ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘স্যার, আপনার সন্তানরা সবাইকে বিরক্ত করছে। আপনি কি এদের আরেকটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না?’ ভদ্রলোকের যেন কিছুটা সম্বিত ফিরে এসেছে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওহ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কিছু একটা করা উচিত। আমরা মাত্র হাসপাতাল থেকে এলাম, যেখানে ওদের মা ঘণ্টাখানেক আগেই মারা গেছেন। আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে কী ভাবব; আর ওরাও বুঝতে পারছে না কিভাবে এটাকে সামাল দেবে।’ কেউ কি ভাবতে পারেন, তখন আমার ভেতরে কী মনে হয়েছিল? আমার প্যারাডাইম পাল্টে গিয়েছিল। মুহূর্তেই আমি একই বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করলাম। কারণ আমি ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমি ভিন্নভাবে অনুভব করেছিলাম। আমি ভিন্নভাবে আচরণ করছিলাম। হঠাৎ করেই আমার ভেতরে ওই মানুষটার কষ্টটুকু অনুভব করতে শুরু করলাম। তার প্রতি সহানুভূতি নেমে এলো। আমি তাকে ধরা গলায় বললাম, ‘কিছুক্ষণ আগে তোমার স্ত্রী মারা গেছেন? ওহ, আমি খুবই দুঃখিত! তুমি কি আমাকে কিছু বলতে পার? আমি কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি?’ মুহূর্তেই পাল্টে গেল সব। তৈরি হলো নতুন প্যারাডাইম। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ [email protected]
×