ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

বিজয় দিবসে তারুণ্যের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

বিজয় দিবসে তারুণ্যের ভাবনা

প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একটা নিজস্ব সমৃদ্ধশালী ইতিহাস আছে ঠিক তেমনিভাবে আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রেরও আছে সমৃদ্ধশালী ইতিহাস। যে ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আর তা নানান পথ পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পূর্ণতা পেয়েছিল। আমরা বা আমাদের প্রজন্ম নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমরা মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমাদের স্বীয় চোখে অদেখা ছিল সাধারণ বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর দমন পীড়ন শোষণ অতঃপর ঐক্যবদ্ধ মুক্তিকামী বাঙালীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ আর জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া, ফলাফলে প্রিয় মাতৃভূমিকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, চেতনার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। তাদের দেশকে জানার, দেশকে ভালবাসা, দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ কতটুকু তার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রয়েছে সুদীর্ঘ রক্তঝরা ইতিহাস। এ স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া একমুঠো মুক্তো বা বদান্যতার উপহার নয়। এক সাগর রক্ত ও লক্ষ্যপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। ঐক্যবদ্ধ জীবন প্রচেষ্টা, মিলন-বিরহ, আশা-নিরাশার বাস্তব অনুভূতি সংবলিত এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজেয় এ চেতনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন করে পরিচিত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি ধারণা পোষণ করে আসুন তা জেনে নেই। ইংরেজী বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুস্মিতা ভট্টাচার্য, তার মতে আজ স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পর আমাদের তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিন্তাভাবনার ওপর নির্ভর করছে অনেককিছু, দেশকে জানার, দেশকে ভালোবাসার, দেশের জন্য কোনকিছু করার আগ্রহ আমাদের কতটুকু তার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বাংলাদেশের ইতিহাস জানার নির্ভরযোগ্য তেমন কোন মাধ্যম নেই, তাই যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেকক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীরা হারিয়ে যাচ্ছেন কালের গর্ভে। যদি ইতিহাস সাক্ষীরাই না থাকেন তাহলে আমরা সঠিক ইতিহাস জানব কি করে? মুক্তিযুদ্ধারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন শুধুমাত্র দেশকে ভালোবাসতেন বলে। এখনকার তরুণ প্রজন্মের আমরা আমাদের স্বাধীনতা সেদিনই পাব যেদিন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থাকা কালো হাতগুলোকে উপযুক্ত শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে পারব। ইতোমধ্যে তা কিছু অংশে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু জাতি অপেক্ষারত শেষটুকু দেখার জন্য। আমাদের স্বপ্ন একটি সুখী শান্তিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। মুন্নি খান, ঢাকা সিটি কলেজ থেকে সবে মাত্র এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করছে তার চোখে- ছোটবেলায় স্কুল থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হতো। জাদুঘরের ভেতরে যখন ঢুকতাম, তখন একটার পর একটা বিষয় দেখতাম, কেমন ছিল আমাদের পতাকা, কোন অস্ত্রে যুদ্ধ হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা আসলে কীভাবে দেশটাকে স্বাধীন করেছেন। এগুলো দেখার পর আমার মনে হতো, আমাদের দেশে কোন দেশ বিরোধী পাকিস্তান বা ভারতের দালাল থাকতে পারে না। দেশে এখনও অনেক মানুষ আছে বা যথেষ্ট সম্পদ আছে, যা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ করা সম্ভব। এর আগে আমাদের অনেক কিছু দেখার ও জানার আছে, যেগুলো দিয়ে আমরা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে পারি। দেশকে উজ্জীবিত করতে পারি। আমাদের হতাশ হওয়ার বা দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময় বা সুযোগ নেই। মমতাজ ইসলাম চৌধুরী ফারিহা, সিলেটের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার চোখে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি বলার সঙ্গে মনে যে চিত্র ভেসে ওঠে তা হলো বড়দের মুখে শোনা গল্পগুলো। রাতের অন্ধকারে পাক বাহিনীদের নিরীহ মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন, চারপাশে ভয় আর আর্তনাদ, নিরীহ শিশু আর মা বোনের ওপর অত্যাচার। সেই অত্যাচার থেকে সবাইকে মুক্তি দিতেই আমাদের দেশের ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করতে, তাদের সঙ্গে যোগ দেন নির্যাতিত নারীরাও, তাদের ত্যাগের বিনিময় এ আমরা পেলাম স্বাধীন এ বাংলাদেশ। সময়ের সঙ্গে ইতিহাস চাপা পড়ছে নতুন প্রজন্ম এর অনেকেই আমাদের ইতিহাস ভাল করে জানেন না। তাদের সবার জানা উচিত, উচিত দেশকে ভালোবাসা। মোঃ ফজলে এলাহি মুবিন, সবে মাত্র একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়েছে তার চোখেÑ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন একটি রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। মুক্তি পেয়েছি পূর্ব পাকিস্তান থেকে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত হয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু অনেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, ভাষা আন্দোলনসহ অনেক কিছু সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। এমন কি জানার আগ্রহ ও থাকে না। যার দরুন আমার মনে হয় দেশের প্রতি সে ভালোবাসা অনেকের মধ্যেই নেই। আমাদের দেশটি মানচিত্রে এত সহজে জায়গা করে নেয়নি। অনেক ত্যাগ স্বীকার করে, অনেক রক্ত ঝড়িয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের দেশের ইতিহাস জানা আমাদের সবার উচিত। তার মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত হবে ফলে মানুষ এমন কোন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে না যাতে দেশের কোন ক্ষতি হয়। সৈয়দা মুজতাবা আনিকা, চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার চোখে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আগে আমাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায়নি বলেই আমাদের পূর্বসূরিদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আমাদের নাড়া দিত না তবে এখন আমরা এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। তবে এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই নয়, আমাদের নবীন প্রজন্মদের অনেকেই জানে না আমাদের বাংলা সংস্কৃতি, সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবেই তারা বড় হচ্ছে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে; এই দেশে জন্মে এই দেশের আলো-বাতাস গায়ে মেখে। তারা জানে না ষড়ঋতু মানে কি বা কয়টি ঋতু আছে আমাদের, তারা জানে না বাংলা বারো মাসের নাম তবুও তারা বিশ্বাস করে তারা বাঙালী, তারা বাংলাদেশী। যেহেতু পূর্বে আমরা প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত ছিলাম তাই যে যেভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছেন আমাদেরও ঠিক সেভাবেই বিশ্বাস করতে হয়েছে। তবে এখন আমরা সবাই অনেক সচেতন এই ব্যাপারে। আয়মান খান, পড়াশোনা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়- তিনি বলেন, যখন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মনে পরে চোখের জল সংবরণ করতে পারা যায় না। তার মতে, স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের মধ্যে অনেকেই এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যাদের বীরত্বের কারণে জাতি মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল তারাই এখন দিন কাটাচ্ছেন অবর্ণনীয় কষ্টে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঠকিয়েছি। তাদের কিছুই দিতে পারিনি। ন্যূনতম সম্মানও দিতে জানি না আমরা। অদিতি মহারতœ, সদ্য পাস করে বের হয়ে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সেলস পারসন হিসেবে কাজ করছেন তার চোখে আমাদের বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ- এটার একটি বিশেষত্ব আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরাই প্রথম জাতি, যারা কিনা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। অন্য দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস পড়ে আমরা যেটা জানতে পারি, তাদের বিশাল অস্ত্রসজ্জিত প্রশিক্ষিত বিশাল সামরিক বাহিনী থাকে। কিন্তু পক্ষান্তরে আমাদের তেমন প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী ছিল না। তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানে যত উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। সেই হিসেবে আমারা নিরস্ত্র মানুষ সংগঠিত হয়ে যুদ্ধ করেছি। একাত্তরে অস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধও চলছিল, যাঁরা যুদ্ধের পাশাপাশি গান গেয়ে, নাটক করে জনমত তৈরি এবং যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। এমনটি আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
×