ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণে বেঁচে আসা রোহিঙ্গাদের জবানীতে রোমহর্ষক যত কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রাণে বেঁচে আসা রোহিঙ্গাদের জবানীতে রোমহর্ষক যত কাহিনী

এইচএম এরশাদ, উখিয়া সীমান্ত থেকে ফিরে ॥ রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন অভিযানে চলমান জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়ার কারণে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা দমন অভিযানে ভিটামাটি হারিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। ১২ নবেম্বর থেকে ১১ডিসেম্বর পর্যন্ত একমাসের মধ্যে বিজিবির চোখে ফাঁকি দিয়ে একশ্রেণীর দালালের মাধ্যমে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ রোহিঙ্গা ক্যাম্প-বস্তি, কেউ সৈকত এলাকায় আবার কেউ কেউ স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়ে পরবর্তী কোথাও অবস্থানের কখা ভাবছে। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের উত্তর মংডুর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর ১০অক্টোবর থেকে ধরপাকড়, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িতে আগুন ও ভিটাছাড়া করে দেশত্যাগে বাধ্য করে আসছিল দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশ। নির্মম হত্যা ও অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসে নির্যাতিত ওই রোহিঙ্গা পরিবার। তবে অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি নিয়মিত টহলে রয়েছে। টেকনাফ সীমান্তে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে রোহিঙ্গা বোঝাই ১৩টি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। রবিবার ভোরে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাগুলো মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় বিজিবি সদস্যরা। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, নাফ নদী পার হয়ে সীমান্তের দুটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই ১৩টি নৌকা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। ও সময় বিজিবির টহল দলের সদস্যরা তাদের বাধা দেয় এবং মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। তিনি আরও জানান, গত ১ নবেম্বর থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্তের ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে ২৬২টি নৌকায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ২ হাজার ৬শ’ রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করা হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত বিজিবির টহল জোরদার রয়েছে বলেও জানান বিজিবির এই কর্মকর্তা। রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এখনও নির্যাতন চলছে বলে জানা গেছে। মংডুর জাম্বুনিয়াপাড়ার গৃহবধূ রোহিঙ্গা নারী সানজিদা (৩০)। সেনাবাহিনীর বর্বর হামলায় হারিয়েছেন প্রিয় স্বামীকে। মাটিতে ফেলে তার চোখের সামনে স্বামীকে লম্বা দা দিয়ে জবাই করেছে সেনারা। হারিয়েছেন তিন সহোদর: হাফেজ বদরুল আলম, নুরুল বশর ও হাফেজ মোঃ এয়াকুবকে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অসহায় সানজিদা। বসতগৃহ জালিয়ে দিয়ে সেনারা তাকে ভিটামাটি ছাড়া করেছে। বেঁচে থাকা দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। অপর রোহিঙ্গা নারী মিনারা (২১)। তিনি স্থায়ী বাসিন্দা মিয়ানমারের কেয়ারিপ্রাং গ্রামের। তার স্বামীর নাম আতাউর রহমান। দেশটির সেনাবাহিনী তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। তাকেও ধর্ষণ করেছে। তাই প্রাণ বাঁচাতে একমাত্র শিশুকে কোলে করে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। আশ্রয় নিয়েছেন কুতুপালং বস্তিতে (স্থানীয় ভাসায় টাল)। তার সঙ্গে দলবেঁধে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মৃত বশিম উল্লাহর স্ত্রী জান্নাত আরা। সেনাবাহিনী ও সেদেশের রাখাইনরা যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে, তার বক্তব্য শুনলে শরীর শিউরে ওঠে। অক্টোবরের মাঝামাঝি। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে হঠাৎ সেনা বাহিনীর টহলদল তাদের বাড়িতে এসে তার স্বামী, দেবর ও শ্বশুরকে কোন কথা বলতে না দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। দুজন আমার হাত ধরে জোরপূর্বক টেনে বাড়ির পাশে ক্ষেতে নিয়ে যায়। আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পায়, আমার বুকের ধন দুই জাদু (সন্তান) ও শাশুড়িকে ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দাউ দাউ করে জলে ওঠে আমাদের বাড়ি। ক্ষেতে আমাকে জোরপূর্বক একাধিক সেনা সদস্য ধর্ষণ করে। সূর্য উদয়ের অনেকক্ষণ পর সকালে জ্ঞান ফিরলে দেখতে পাই আমার শাশুড়ি ও দুই ছেলেমেয়ে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী কখন যে চলে গেছে তা আমি জানি না। নিজের প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশীদের হাতে-পায়ে ধরে তাদের দলে ভিড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। এখন প্রায় দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা দাবি করে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে জান্নাত আরা আরও বলেন, শুনেছি আত্মহত্যা মহা পাপ। তাই সময় এলে স্বাভাবিকভাবে মরতে চাই। তবে গর্ভের সন্তান যদি জন্ম হয়, তা হলে আমার কি হবে-তা ভেবে পাচ্ছি না। নেইছাপ্র“ গ্রামের আবদুর রহমানের স্ত্রী আনোয়ারা (৩৫), দুই শিশু আহমদুর রহমান (৫) ও মিনারাকে (৭) নিয়ে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার কুতুপালং বস্তিতে। তার চোখের সামনে স্বামীকে গুলি করে হত্যা করার দৃশ্য মনে পড়লে তার খুবই ভয় হয়। শিশুরা বার বার জানতে চাইছে তাদের বাবার শরীরে গুলি লেগেও নড়াচড়া করছিল। হয়ত বেঁচে আছে। বর্মায় (মিয়ানমার) গিয়ে পিতাকে নিয়ে আসতে শিশুরা চাপাচাপি করলে শুধু কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায় আনোয়ারা। ষাটোর্ধ বৃদ্ধ গুরা মিয়া। মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের মংড়– বড় গৌজিবিল গ্রামের বাসিন্দা। সামরিক জান্তার হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শী হাজারো মানুষের মধ্যে তিনিও একজন। সেনাবাহিনীর নরককু- থেকে ফিরে আসা কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নেয়া গুরা মিয়া সাংবাদিক জেনে রবিবার বিকেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। ১০ অক্টোবর বিকেল থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়। তবে ১২ নবেম্বর অভিযান তীব্র হলে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। ঘরে শুধু পাহারা থাকে নারী ও শিশুরা। গৌজিবিল থেকে অদূরে পাগাড়ের কাছাকাছি রাইম্মার বিলে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। গহিন পাহাড়ে আরএসও ঘাঁটি থাকতে পারে সন্দেহে সেদিকে সেনাবাহিনীর টহল কম থাকে। সেনাবাহিনী এসে রাইম্মাবিল পাড়াটি ঘেরাও করে সবাইকে ডেকে জমায়েত করে এক জায়গায়। পরবর্তীতে মেয়েদের পৃথক করে নিজ নিজ বাড়িঘরে চলে যেতে বললে তারা ফিরে যায়। পুরুষদের হাতে শিকল দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে। ৪দিন পর বন্দীদশা থেকে বুড়ো বয়সের ২০জনকে তারা ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেয়াদের মধ্যে আমিও একজন। ৪দিন ধরে আমাদের খাবারও দেয়নি। এতে আমরা বেশি দুর্বল হয়ে পড়ি। ছেড়ে দেয়াদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে ২জন মারা গেছে মিয়ানমারের ধানক্ষেতে। ঘরে এসে দেখতে পাই সকলের অঝোরে কান্না। পার্শ্ববর্তী ওই ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে যুবতী মেয়েদের গণধর্ষণ ও জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। উঠোনে বেরিয়ে দেখি প্রতিঘর থেকে যুবতীদের কান্নার আওয়াজ। সব মেয়ে একবাক্যে বলছে, তারা সবাই গণধর্ষণের শিকার।
×