ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব

নৃত্য-গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের বিভোরতায় কেটেছে বিনিদ্র রাত

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

নৃত্য-গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের  বিভোরতায় কেটেছে বিনিদ্র রাত

মনোয়ার হোসেন ॥ চার বছর আগেও যেন বিষয়টা ছিল ভাবনার অতীত। তাঁবু ঢাকা খোলা মাঠে কিংবা উন্মুক্ত গ্যালারিতে বসে আছে হাজার হাজার সঙ্গীতানুরাগী। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পেরিয়ে ভোর অবধি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে রাগসঙ্গীত। তাই তো উৎসবের সূচনালগ্নে অনেকেই এ আয়োজনকে পাগলামি বলতেও দ্বিধা করেননি। তবে ভাবনাতীত সে বিষয়টাই ঘটেছে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব জয় করে নিয়েছে শহুরে শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়। পঞ্চম বছরেও সেই ধারাবাহিকতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই মহাযজ্ঞে রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হচ্ছে অগণন সুররসিক। রাগ-রাগিনীর মায়াজাল বোনা উৎসবে শ্রবণের বিভোরতায় কেটে যাচ্ছে বিনিদ্র রাত। বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত পঞ্চরজনীর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় রাত ছিল শুক্রবার। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গীকৃত উৎসবটি অগণন শ্রোতার আগমনে ছুটির দিনে আরও বেশি জমাট বেঁধেছিল। কখনও কণ্ঠে কখনও যন্ত্রের সুর-তাল ও লয়ের মায়াবি মূর্ছনায় সিক্ত হয়েছেন অগণন শ্রোতা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত পঞ্চমবারের উৎসবের দ্বিতীয় রাত্রিতে এমন নয়নজুড়ানো দৃশ্যের দেখা মিলেছে। রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শ্রোতার সংখ্যা। এ রাতের আয়োজনে দেখা মিলেছে চোখজুড়ানো ওড়িশি নৃত্য, শোনা গেছে হৃদয় উচাটন করা তবলার বাদন, সন্তরের সুমধুর সুর, সেতারের ¯িœগ্ধ শব্দধ্বনি, বাঁশি ও ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি পরিবেশনা ও মোহময় খেয়ালের সুর। দ্বিতীয় নিশীথের অনুষ্ঠানের সূচনা হয় ভারতীয় দুই গুরু-শিষ্যের ওড়িশি নৃত্য পরিবেশনায়। প্রথম উপস্থাপনাটি মেলে ধরেন ওড়িসি নৃত্যধারার খ্যাতিমান শিল্পী বিদুষী মাধবী মুডগাল। ভারত সরকারে পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত ও ফরাসি সরকারের ‘শেভালিয়ে দ্য লর্দ দেজার্ত এ দ্য লেত্র’ সম্মাননাপ্রাপ্ত এ শিল্পী নটরাজ ও অষ্টপদি শীর্ষক নাচ দিয়ে মেলে ধরেন ময়ূরের চলনভঙ্গি। সেই সঙ্গে উঠে আসে কৃষ্ণ ও রাধার অমর প্রেমগাঁথা; যা মধ্যযুগের কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ থেকে আশ্রিত। মাধবীর পরিবেশনা শেষে নাচ করেন তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্রী ও শিষ্যা আরুশি মুডগাল। দ্রুত তালের নাচে এই শিল্পীও আপন করে নেন মঞ্চকে। রাগ সাহানায় ‘আলহাদ’ শিরোনামের পরিবেশনায় উঠে আসে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অনুভূতি। এছাড়া এই শিল্পী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী’ গানের সুরে নৃত্য পরিবেশন করেন। সব শেষে গুরু-শিষ্যর যুগলবন্দীতে পরিবেশিত ভৈরবী পল্লøবী শীর্ষক নাচ । তাঁদের পরিবেশনায় কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন মনিকুন্তলা ভৌমিক ও ক্ষীতি প্রকাশ মহাপাত্র, পাখওয়াজে ছিলেন জিতেন্দ্র কুমার সাইন, সেতারে ইয়ার মোহো ও বাঁশিতে ছিলেন শ্রীনিবাস সত্যপঠী। আবহসঙ্গীত পরিবেশন করেন মধুপ মুডগাল ও সমরজিৎ রায়। সঙ্গে ছিল বাঁশি, মৃদঙ্গ ও সেতারের মূর্ছনা। ওড়িশি নাচ শেষ হতে বেজে ওঠে সম্মিলিত তবলার বাদন। মঞ্চে আসে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের নবীন শিল্পীরা। এই তবলিয়া দলে ছিলেন চিন্ময় ভৌমিক, ফাহমিদা নাজনিন সুমাইয়া, এম জে জে ভূবন, নুসরাত-ই-জাহান খুশবু, পঞ্চম স্যানাল, প্রশান্ত ভৌমিক ও সুপান্থ মজুমদার। এই তবলিয়াদের পরিবেশনাটিও প্রশংসা কুড়িয়েছে সবার। দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নবজাগরণের ইঙ্গিতবহ পরিবেশনাটি ছিল তিনতালে। হারমোনিয়ামে ছিলেন মিলিন্দ কুলকার্নি। তবলার বাদন শেষে খেয়াল শোনান বাংলাদেশের শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। এবারের উৎসবে স্বদেশের শিল্পীদের উদ্দীপনা জাগানো রাতে রাগ বাগেশ্রীতে খেয়ালের আশ্রয়ে শুরু করেন পরিবেশনা। কৌশিকধ্বনিতে ঠুমরি পরিবেশনের মাধ্যমে পরিবেশনার ইতি টানেন প্রিয়াঙ্কা। তবলায় তাঁকে সঙ্গত করেন ইফতেখার আলম প্রধান। প্রিয়াঙ্কা গোপ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তার পুরো পরিবেশনাতেই। ইফতেখার আলম প্রধান বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত তবলাশিল্পী। ২০১৬ সালে ইফতেখার লন্ডনের প্রখ্যাত রয়েল এ্যালবার্ট হলে ‘এ্যা ক্ল্যাসিকাল অডিসি : ট্রিবিউট টু রবিশঙ্কর’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পীদের সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে তবলা পরিবেশন করেন। দ্বিতীয় রজনীর অন্যতম আকর্ষণ রাহুল শর্মার সন্তুর পরিবেশনা। সন্তুরের শ্রুতিমধুর সুর যেন আরও এক ধাপ ছাপিয়ে যায় শিল্পীর অনবদ্য পরিবেশনায়। ঘণ্টা ব্যাপ্তির পরিবেশনায় রাগ গাবতিতে মুগ্ধ করে রাখেন শ্রোতাদের। আলাপ জোড় ঝালা পর্ব পেরিয়ে রূপক তালে মধ্যলয়ে এবং দ্রুত তিন তালের সমন্বয়ে সাজানো ছিল তাঁর পরিবেশনা। কণ্ঠসঙ্গীত ও সন্তুর বাদনে রাহুল শর্মার হাতেখড়ি তার পিতা প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতবেত্তা প-িত শিবকুমার শর্মার কাছে। তিনি রিচার্ড ক্লেডারম্যান ও কার্সি লর্ডসহ খ্যাতিসম্পন্ন বহু গায়ক ও বাদকের সঙ্গে একই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। রাহুল শর্মাকে তবলায় সঙ্গত করেন আরেক জনপ্রিয় তবলিয়া সত্যজিৎ তালওয়ালকার। পিতা স্বনামধন্য তবলিয়া প-িত সুরেশ তালওয়ালকার ও মাতা বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকারের কাছে সত্যজিৎ তালওয়ালকারের হাতেখড়ি। পিতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি একজন চৌকস তবলা শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। ওয়ার্ল্ড মিউজিক, ফিউশন ও জ্যাজেও তার আগ্রহ অনেকেরই জানা। লুই ব্যাঙ্কস ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পারকাশনিস্ট ত্রিলোক গুর্তুর সঙ্গে তিনি একই মঞ্চে বাজিয়েছেন। দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ শোয়েব ও অন্যান্যরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের এই শিক্ষকের নেতৃত্বাধীন সম্মেলক পরিবেশনাটিও ছুঁয়ে গেছে শ্রোতার হৃদয়। সম্মেলক কণ্ঠে উপস্থাপিত হয় রাগ দরবারি। এ পরিবেশনায় তবলায় ছিলেন ইফতেখার আলম প্রধান ও পাখওয়াজে সুষেণ কুমার রায়। সেতারে সুর ছড়ান পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ভারতের প্রখ্যাত এই সেতারবাদক সেনিয়া মাইহার ঘরানায় আবহে কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। শঙ্কর মহাদেবন ও ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে যুগল পরিবেশনা করেছেন অনেকবার। এই উৎসবের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী প-িত উলহাস কশলকর। তিনি খেয়াল পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সুরেশ তালওয়ালকার। প-িত উলহাস কশলকারের হাতেখড়ি পিতা এনডি কশলকারের কাছে। প-িত রাম মারাঠে ও প-িত গজাননবুয়া যোশীর কাছে তিনি তালিম নেন। বর্তমানে গোয়ালিয়র, জয়পুর এবং আগ্রা ঘরানার একজন ধারক ও বাহক হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে অবদানের জন্য উল্লাস কশলকার পদ্মশ্রী, যদু ভট্ট পুরস্কার, স্বররতœ পুরস্কার ও সঙ্গীত নাটক আকাদেমি এ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। জগৎগুরু শঙ্কাচার্য তাকে গানতপস্বী খেতাবে ভূষিত করেছেন। দ্বিতীয় রাতের আরেক আকর্ষণ ছিল প-িত রনু মজুমদারের বাঁশি ও ইউ রাজেশের ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দী পরিবেশনা। রনু মজুমদার ভারতের একজন প্রতিষ্ঠিত বংশীবাদক। তার প্রকৃত নাম রনেন্দ্রনাথ মজুমদার তবে রনু মজুমদার নামেই তিনি বেশি পরিচিত। মাইহার ঘরানার এই বাদ্যশিল্পী আর্ট অব লিভিং অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে ৫,৩৭৮ জন বংশীবাদকে উপস্থাপন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিষয়টি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। আর ইউ রাজেশ ভারতের একজন বিশিষ্ট ম্যান্ডোলিন শিল্পী। ম্যান্ডোলিনের স্বনামধন্য শিল্পী ইউ শ্রীনিবাসের ভ্রাতা ইউ রাজেশ তার বাবা ও ভাইয়ের কাছে তালিম নেন। জন ম্যাকলফ্লিনের এ্যালবাম ‘ফ্লোটিং পয়েন্টে’ ম্যান্ডোলিন বাদনের জন্য গ্র্যামি পদকের জন্য তিনি মনোনয়ন লাভ করেছিলেন। এভাবে ম্যান্ডোলিন আর বাঁশির মধুর পরিবেশনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় বেঙ্গল উচ্চঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় রজনীর পরিবেশনা। একটু পরেই রাজধানীর বুকে নেমে আসে ভোর। আজকের পরিবেশনা : আজ শনিবার উৎসবে তৃতীয় দিনের পরিবেশেনা শুরু হবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীদের দলীয় সরোদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। বাঁশি বাজিয়ে শোনাবেন শশাঙ্ক সুব্রহ্ম্যণন। তার সঙ্গে মৃদঙ্গমে থাকবেন পারুপল্লী ফাল্পুন, তবলায় সত্যজিৎ তালওয়ালকার। খেয়াল পরিবেশন করবেন ড. প্রভা আত্রে। তার সঙ্গে তবলায় থাকবেন রোহিত মজুমদার। তবলা বোলে মাত করবেন প-িত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। প-িত উদয় ভাওয়ালকার পরিবেশন করবেন ধ্রুপদ। সেতার বাজিয়ে শোনাবেন প-িত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবলায় থাকবেন পরিমল চক্রবর্তী। ওস্তাদ রশিদ খানের খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তৃতীয় দিনের পরিবেশনা। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করবেন প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
×