ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙছে ১৬২ বছরের রেকর্ড

মৌলভীবাজারে চা উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১০ নভেম্বর ২০১৬

মৌলভীবাজারে চা উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন, মৌলভীবাজার ॥ চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার জেলায় দেশের ১ শ’ ৫২টি চা বাগানের মধ্যে ৯৫টি চা বাগান রয়েছে। মৌলভীবাজার জেলার উঁচু নিচু পাহাড়, টিলায় ১,৬০,২৬৪.৭৮ একর জায়গা জুড়ে ৯৫টি চা বাগান রয়েছে। ১৮৫৬ সালে এ জেলার জঙ্গলে প্রথম চা গাছ দেখা যায় এবং ১৮৫৭ সাল থেকে চায়ের চাষ শুরু হয়। ব্রিটিশ আমলে চা বাগানের শ্রমিকদের আনা হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে ভারতের উরিষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে। এ চা বাগান শ্রমিকদের কুলি বলা হয়। চা একটি কোমল পানীয়। এক সময় দেশের এ কোমল পানীয় বা চা বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো। দেশের অভ্যন্তরে দিন দিন চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি পায় কিন্তু চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় বিদেশ থেকে চা আমদানি করতে হতো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে পিছিয়ে পড়লেও সম্ভাবনাময় সেই চায়ের উৎপাদনে আবারও অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। দেশের চা উপাদনের মূল আধার হিসেবে বিবেচিত মৌলভীবাজারসহ অপর জেলাগুলোতে চলতি বছর উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে বসেছে। ২০১৫ সালে দেশে চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। ওই বছর দেশে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। যা এযাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে সেই রেকর্ড এবার ভাঙতে বসেছে বলে মনে করছেন সংশিষ্টরা। এ বছর সময়মতো বৃষ্টিপাতের ফলে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদনের এ ধারা দিন দিন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আগের মতোই আবারও চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি ও গত কয়েক বছর চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বাড়ে চায়ের আমদানি। অনুকূল আবহাওয়া ও নতুন কিছু উদ্যোগের ফলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে উৎপাদন। সংশিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের ৯৫টি বাগানসহ বাংলাদেশের সবগুলো বাগান চা রফতানি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। গত এক দশক আগে নানা জটিলতায় চায়ের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। দেশীয় বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ওই সময়ে রফতানির পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে চা আমদানি করতে হয়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়া ও নানা সমস্যা সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। চা উৎপাদনে বাগান কর্তৃপক্ষ আগের মতো প্রকৃতির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সময় মতো পানি, সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে উৎপাদন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ রেকর্ড ১৬২ বছরের উৎপাদনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সংশিষ্টদের ধারণা। চা বোর্ডের শ্রীমঙ্গলের প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের পরিচালক বলেন, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। তবে আরও এক মাস সময় অতিবাহিত হলেও এর সম্পূর্ণ হিসাব পাওয়া যায়নি। চা বাগান সংশিষ্টরা বলছেন, ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি), ফিনলেসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানগুলোতেও এই সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়েছে। তাদের ধারণা, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উৎপাদনের সাথে গত একমাসে সবগুলো বাগানের উৎপাদন যুক্ত করলে গত বছরের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে। দেশের ১৬২ বছরের বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের সব রেকর্ড ভেঙে এ বছর দেশে চায়ের উৎপাদন ৭০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন চা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। মৌসুম শেষে চা উৎপাদনে সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টির ধারণা ক্রমেই বাস্তব রূপ লাভ করছে। আর বছরের শেষ পর্যন্ত উৎপাদনের এ ধারা ঠিক থাকলে তা হবে গত ১৬২ বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড এমন ধারণা দিয়েছেন সংশিষ্টরা। সংশিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৫ সালে দেশে চা উৎপাদন হয় ৬ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি। কিন্তু ২০০৬ সালে উৎপাদন ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার কেজিতে নেমে আসে। পরবর্তী বছর থেকে উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ২০০৭ সালে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার কেজি, ২০০৮ সালে ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার, ২০০৯ সালে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার, ২০১০ সালে ৬ কোটি ৪ লাখ, ২০১২ সালে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৩ সালে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। তবে ২০১৪ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার কেজি হলেও ২০১৫ সালে তা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে দেশের বাগানগুলোয় ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়, যা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে। আর চা বাগান সংশিষ্টদের মতে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ২০১৫ সালের উৎপাদনকেও হার মানাবে। এদিকে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে চা রফতানি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৪০ লাখ কেজি। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমেছে রফতানি। সর্বশেষ ২০১১ সালে রফতানি ২০ লাখ কেজির নিচে নেমে আসে। ২০১৪ সালে রফতানি হয় সর্বনিম্ন ১৩ লাখ কেজি। দেশে ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯৫টি। এছাড়া হবিগঞ্জে ২৩, সিলেটে ২০, চট্টগ্রামে ২২, রাঙামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে ও পঞ্চগড়ে নয়টি বাগান রয়েছে। ছোট পরিসরের চা চাষসহ দেশে চা বাগানের মোট ভূমি ১ লাখ ১৬ হাজার ২১৯ হেক্টর। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ অর্থাৎ ৫৮ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় রয়েছে। ৩৯ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে রাবার, বাঁশ, ধান, কাঁঠাল, লেবুসহ বিবিধ ফলের চাষ, পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত বনায়ন রয়েছে। ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) ডিজিএম মোঃ শাহজাহান বলেন, আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশের কারণেই এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হয়েছে। অন্যান্য বছরের সেপ্টেম্বরে সচরাচর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় রেডস্পাইডারসহ চা গাছে রোগব্যাধি সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ বছর সেপ্টেম্বরেও বৃষ্টিপাত হওয়ায় চা বাগানে রোগের তেমন আক্রমণ দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হলেও ইতিমধ্যে অক্টোবর মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন হবে এবং অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
×