ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বই পড়ার পাশাপাশি সিনেমাও বুদ্ধিবৃত্তির সহায়ক

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

বই পড়ার পাশাপাশি সিনেমাও বুদ্ধিবৃত্তির সহায়ক

গ্রীক সভ্যতায় বই পড়াকে আত্মার চিকিৎসা বলা হতো। শুধু মানসিক বিকাশ ছাড়াও আমাদের বক্তিগত ও সমাজ জীবনে সাহিত্যের প্রয়োজনীতা অপরিসীম। সব্যসাচী লেখক প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের মতে ‘আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু ব্যবহার করি তার অনেক কিছুই সাহিত্যের অবদান।’ এই যে আমাদের সব কাজ গুছিয়ে করা বা সব কিছু গুছিয়ে রাখার প্রবণতা, মার্জিত আচরণ, শুদ্ধ করে কথা বলা, পরিপাটি পোশাক এসব কিছুতে সাহিত্যের অবদান আছে। যে সব কারণে আমরা নিজেরা বইপড়ার সময় বের করতে না পারলেও আমাদের কনিষ্ঠদের হরহামেশা বইপড়ার উপদেশ দিয়ে থাকি। দ্রুতগতির আধুনিকায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে মানুষকে। যেন যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো। যে কারণে বাড়ছে চাহিদা, আর চাহিদার শর্তপূরণ করতে সময় নিয়ে মানুষের সবচেয়ে বড় টানাটানি। সময়ের এই টানাটানির সময়ে বই পড়ার জন্য সময় বরাদ্দ থাকে না আমাদের। তাই আজকাল নিজেরা বই না পড়ে ছোটদের বই পড়ার উপদেশ দিয়ে থাকি। এই সময়ের ছাত্রছাত্রীরা ভিডিও গেমস, স্যাটেলাইট টিভি, কম্পিউটার, ফেসবুক, অনলাইনে উপার্জন ইত্যাদি নানা কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তাদেরও বইপড়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে দিন দিন। অথচ বৈজ্ঞানিক মতে মানুষের মস্তিষ্ক এক বিপুল জ্ঞানের ভা-ার যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে সে ভা-ার প্রস্ফুটিত হয়। সে চর্চায় বই পড়ার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। এমনকি বই পড়ার পরিপূরকও আর কিছুই নেই। তবে জানার, বোঝার বা আত্মোন্নয়নের জন্য সাহিত্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রও মানুষের জ্ঞান চর্চার সপক্ষে সহায়ক হতে পারে। এ ব্যস্ত সময়ে মানুষের আলাদা করে সময় না থাকলেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা দেখা যেতে পারে। সপ্তাহে অন্তত দু-তিন ঘণ্টা সময় বের করে পরিবার , বন্ধুবান্ধব বা ছোটদের নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাস তৈরি করা যায়। যেহেতু মানুষের এখন সর্বক্ষণিক সঙ্গী যন্ত্র সেহেতু সিনেমা হলে যেতে না পারলেও যে কোন সময় যে কোন অবস্থাতেই সিনেমা দেখা যায়। বই পড়ার মতো করে ছোটদের ভাল চলচ্চিত্র দেখার জন্য উৎসাহও প্রদান করা যেতে পারে। চলচ্চিত্র ভাল কি খারাপ তা নির্ভর করে এর বিষয়বস্তুর ওপর। সেজন্য চলচ্চিত্রে রয়েছে শ্রেণীবিন্যাস। তবে জানা, বোঝা, উপলব্ধির জন্য চলচ্চিত্র একটি কার্যকরী মাধ্যম। সমাজ হচ্ছে সমষ্টিগতভাবে বসবাসের একটা ভাবনা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক মুহূর্তের সমন্বয়ে চলন্ত ছবির ধারাবাহিকতাই চলচ্চিত্র। কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ের, নির্দিষ্ট স্থানের, নির্দিষ্ট ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর একক বা সমষ্টিগত আচরণকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র। যা এক বা একাধিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। ওই স্থানের, সময়ের, গোষ্ঠীর ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে তুলে ধরা হয় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। উপস্থাপনার বার্তা প্রেরণ ও প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হয় দৃশ্য ও শব্দ। যে কারণে ছবিগুলো জীবন্তের মতো মনে হয়। তাই জীবন, সমাজ বাস্তবতা ও চলচ্চিত্র একে অন্যের প্রতিবিম্ব। চলচ্চিত্রে মানুষের জীবন সংগ্রাম ও সমাজ বাস্তবতার চিত্র প্রতিফলিত হয়। তেমনি জীবন সংগ্রামে এবং সমাজ বাস্তবতায় চলচ্চিত্রের এক ধরনের প্রভাবও পড়ে। কেননা প্রতিটি চলচ্চিত্র তার লক্ষণীয় দর্শকের জন্য শিক্ষাণীয়, তথ্যবহুল ও বিনোদনমূলক, যা জীবনযাপনে, ব্যক্তিক মনোভাবে, আচরণে, যে কোন সামাজিক অংশগ্রহণে ও সমাজিকীকরণে সহায়ক হিসেবে ব্যাপক প্রভাব আনে। তাই কখনও কখনও চলচ্চিত্র হতে পারে সামাজিক প্রদর্শক বা প্রগতির শক্তি। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের একটা বিতর্কিত দিক হলো চলচ্চিত্র হিংস্র্র সামাজিক আচরণকেও প্রভাবিত করে। বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস মতে, কিশোর ও যুব সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গে চলচ্চিত্র এবং ভার্চুয়াল গেমসের এক ধরনের সম্পর্ক আছে। আবার বৈজ্ঞানিকভাবে এটাও প্রমাণিত যে, একজন ব্যক্তিকে জৈবিক জীব থেকে মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষে রূপান্তর করতে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। তাই এসব কিছু বিবেচনা করে ১৯১২ সালে দি ব্রিটিশ বোর্ড অব ফিল্ম ক্লাসিফিকেশন (বিবিএফসি) চলচ্চিত্রের শ্রেণীবিন্যাস তৈরি করে। অর্থাৎ সব চলচ্চিত্র সবার জন্য নয়। প্রত্যেকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তার নির্দিষ্ট দর্শক গোষ্ঠীর জন্য। চলচ্চিত্রকে দেখা উচিত সাংস্কৃতিক শিল্প হিসেবে। কেননা চলচ্চিত্র হচ্ছে লিঙ্গ, শ্রেণী ও জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বের কার্যকরী তথ্যভা-ার। একটি চলচ্চিত্রের চলমান জীবনচিত্র তার দর্শকের কাছে নানাভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক কোন একটি চলচ্চিত্রে একজন মানুষের সফলতার পেছনের গল্প তুলে ধরা হলো। সেখানে তার জীবন ভ্রমণের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, অধ্যবসায়, অনুশীলন, কৌশল, বুদ্ধিবৃত্তি, বিশেষ মুহূর্তের বিশেষ সিদ্ধান্ত এবং সেই চরিত্রের দৃঢ়তাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখান হয়। যেটা থেকে একজন মানুষ উৎসাহপ্রাপ্ত বা অনুপ্রাণিত হতে পারে। চলচ্চিত্রের কোন একটা চরিত্রের সফলতা বা ব্যর্থতার গল্প একজন দর্শকের জীবনে শিক্ষণীয় প্রভাব ফেলতে পারে। সে প্রভাবে দর্শকদের মাঝেও আচরণগত ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। কেননা ওই চরিত্র ও গল্পের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার কোন একটি সামাজিক দর্শনকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। চলচ্চিত্রে উঠে আসে বিভিন্ন সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বাস্তবতা, সম্পর্কের কথা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সফলতা, ব্যর্থতা, ন্যায়-অন্যায় বিচার, জয়, পরাজয়, শান্তি, শাস্তি ইত্যাদির চিত্র। যেসব চিত্র এক ধরনের সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন-পূর্ব ইউরোপের সংস্কৃতির অন্বেষণে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব ব্যাপক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে জহির রায়হান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে নবচেতনার সূত্রপাত করেন তা এ দেশের মানুষের বিচ্ছিন্ন চেতনাবোধকে সামষ্টিক রূপ দিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ঋত্ত্বিক কুমার ঘটক তার চলচ্চিত্রের মাঝে মানুষের ক্ষোপ, অভিযোগ, অসমতাকে অধিকার আদায়ের শক্তিতে রূপান্তর করার আহ্বান করেছেন। দেখিয়েছেন সময়ের স্র্রোতের সঙ্গে সম্পর্কের রূপান্তর। যার সবকিছু তথ্যবহুল ও শিক্ষণীয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে সাদা-কালোর দ্বন্দ, ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, শাসক ও শাষিতের দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন। পরিলক্ষিত হয়েছে ভাবনার পার্থক্য। যা মানুষকে মানসিকভাবে আধুনিক হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। চলচ্চিত্রের অনবদ্য অবদানে মানুষ খুব সহজেই এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার পার্থক্য জানতে পারে। মানুষ উপলব্ধি করতে পারে বিভিন্ন সময়ের রূঢ় বাস্তবতা। মানুষের জীবনযাপনে নতুনত্ব সৃষ্টিতে, আচরণগত পরিবর্তনে, সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা ব্যাপক কার্যকর। যে অনুপ্রেরণা কখনও কখনও মানুষকে নতুন করে আশান্বিত করতে পারে। সুতরাং সাহিত্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রও মানুষের মস্তিষ্কের ভা-ারকে প্রস্ফুটিত করে। আমাদের বই পড়ার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ থাকাটাও জরুরী এবং ছোটদেরও ভাল চলচ্চিত্র দেখতে উৎসাহিত করা দরকার।
×