ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিনদিনের সফর ॥ বরিশালেও যাবেন

বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্য ॥ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট আজ দেখতে আসছেন

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্য ॥ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট আজ দেখতে আসছেন

আনোয়ার রোজেন ॥ দারিদ্র্য বিমোচনে দক্ষিণ এশিয়ার দুই বড় দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। ভারতে অতিদরিদ্রের হার ২৭ শতাংশের মতো। পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশ অতিদরিদ্র। এ দুই দেশের তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও অতিদরিদ্রের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। অক্টোবরের শুরুতে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ চিত্র ওঠে আসে। এবার নিজ চোখে বাংলাদেশের এই ‘অসাধারণ সাফল্য’ দেখতে আজ রবিবার ঢাকায় আসছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাংক ১৭ অক্টোবর (সোমবার) ‘আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ এখানেই উদযাপন করবে। শনিবার বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, প্রায় এক দশক পর বিশ্বব্যাংকের কোন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তবে দুটি বিশেষ কারণে বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিমের এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। একটি হলো বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং ও দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য। অন্যটি হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্প ঘিরে সম্পর্কে যে ‘ফাটল’ ধরেছিল সেটি যে এখন জোড়া লেগেছে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। বিশ্বব্যাংক প্রধানের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি বড় উৎসব। তার এই সফরের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে বলে আশা করি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) মাধ্যমে সহজ শর্তে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা পেয়ে আসছি এবং বৈশ্বিক অন্যান্য সংস্থার তুলনায় বিশ্বব্যাংকের নিকট থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছি। অর্থমন্ত্রী বলেন, আশা করছি এবার আমরা ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন প্রতিশ্রুতি পাব, যা চলতি ৫২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। এর আগে কখনও সংস্থাটি এক বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেনি। আবার দরিদ্র দেশগুলোর জন্য গড়া বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) তহবিলের সবচেয়ে বড় গ্রাহকও বাংলাদেশ। আইডিএ তহবিলের আওতায় উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২, ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার) সহায়তা দিয়েছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহায়তার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে এটির সুদের হার অনেক কম। এদিক থেকে চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া ঋণ সহায়তার চেয়েও বিশ্বব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু ইস্যু ছাপিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে ‘বাংলাদেশ মডেলই’ এখন সংস্থাটির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের এই ইতিবাচক মনোভাব এ দেশের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর উন্নয়নে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিশ্বব্যাংককে কাজে লাগাতে হবে। এ দিকে বিশ্বব্যাংক বলছে, কঠিন উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে গত দুই দশকে দুই কোটিরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে বাংলাদেশ। দেশটির এই অগ্রগতি সরাসরি দেখার জন্য বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম রবিবার ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ় হওয়া, দরিদ্রবান্ধব ও উদ্ভাবনী কর্মসূচী, বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানব সম্পদ উন্নয়ন বিনিয়োগ ও কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জনকে তিনি ‘দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করতে চান। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বে অনুকরণীয় হয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও শিশু মৃত্যু হার, মাতৃ মৃত্যুহার কমানোয় সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশ দেখিয়েছে- প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র অবলম্বন নয়। স্বল্প আয় নিয়েও অনেক অর্জন সম্ভব। এই সাফল্য দেখতেই বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে শনিবার বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে জিম ইয়ং কিম বলেন, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের উদ্ভাবনী কর্মপদ্ধতি পরিচিতি পেয়েছে সারাবিশ্বে। অনেক দেশ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এখন সুশাসন শক্তিশালী করে এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংক গ্রুপ কিভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে পারে তা জানতে আমি আগ্রহী। এছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামো, মানব উন্নয়ন, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সফরসূচী ॥ সূত্র জানায়, তিন দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে রওনা হয়ে রবিবার রাতে ঢাকা পৌঁছবেন জিম ইয়ং কিম। তিনি রাতযাপন করবেন হোটেল র‌্যাডিসনে। সোমবার সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠকের পর বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ’ শীর্ষক পাবলিক লেকচারে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা দেবেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী ও সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার। বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যানিটি ডিক্সনও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ ‘এ্যান্ড পোভার্টি’ শীর্ষক গান গাইবেন অনুষ্ঠানে। এ পর্বের শেষে ‘প্রসপার বাংলাদেশ’ (সমৃদ্ধ বাংলাদেশ) শিরোনামে একটি প্রেজেনটেশন উপস্থাপন করা হবে। এরপর সেখানে বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর জন্য ‘এ্যান্ড গ্লোবাল পোভার্টি বাই ২০৩০ ঃ শেয়ারিং বাংলাদেশ’স এক্সপেরিয়েন্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায়ও বক্তৃতা করবেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট। মঙ্গলবার সকালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য বরিশাল যাবেন কিম। ফিরে এসে একান্ত বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। একই দিন বিকেলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিদায় নেবেন তিনি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঢাকা আসছেন জিম ইয়ং কিম। সর্বশেষ ২০০৭ সালের নবেম্বরে দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক। ইআরডি কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা ॥ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের ঢাকা সফরকালে নতুন কোন চুক্তি স্বাক্ষরের আভাস না পাওয়া গেলেও সফর ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই সফরকে নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে কাজ করছেন তারা। এজন্য গত মঙ্গলবার দুর্গা পূজা ও বুধবার আশুরার সরকারী ছুটি বাতিল করা হয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বিশ্বব্যাংক উইংয়ের কর্মকর্তাদের। ইআরডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সফর সফল করতে যা যা করা দরকার, তার সবই করা হচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে কোন ফাঁক রাখা হবে না। আশা করছি তার এ সফর ফলপ্রসূ হবে। বরিশালে যাচ্ছেন ॥ স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, আগামী ১৮ অক্টোবর বরিশালে আসছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে ওইদিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তিনি বরিশালে এসে পৌঁছবেন। এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসন বরাবরে একটি বার্তা এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফুননেছা। তিনি আরও জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বরিশালে যে সকল কার্যক্রম রয়েছে সেগুলোর পরিদর্শন করবেন জিম ইয়ং কিম। ওইদিন সকালে জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নের দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত এসডিএফ (সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) এর আওতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালতি লাভলীহুড ইমপ্রুভমেন্ট-নতুন জীবন প্রকল্প পরিদর্শনপূর্বক এক আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন, এসডিএফ সংস্থার জেলা ব্যবস্থাপক আনোয়ারুল করিম। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ানে এসডিএফের আওতাধীন দারিদ্র্য ও অতিদরিদ্র নারীদের উন্নয়নে নতুন জীবন প্রকল্পের দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রাম সমিতির নারী সদস্যদের নিয়ে সকাল দশটায় এক আলোচনা সভায় মিলিত হবেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। এ সময় উপস্থিত নারীদের অবস্থানের পরিবর্তনের কথা শুনবেন এবং নারীদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিভিন্ন প্রজেক্ট পরিদর্শন করবেন। তিনি আরও জানান, নতুন জীবন প্রকল্পটি ঘূর্ণিঝড় সিডর কবলিত মানুষের জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রকল্পে তিন ধরনের কাজ হয়ে থাকে। নারীদের শক্তিশালীকরণে সংগঠন তৈরি করে অবস্থার পরিবর্তন করা, বেকার যুবক-যুবতীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং সহায় সম্বলহীনদের অনুদান দেয়া। এ প্রকল্প পরিচালনার সমূদয় অর্থ বিশ্বব্যাংক অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকেন। এছাড়াও জিম ইয়ং কিম বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এখানকার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং এলজিইডি’র আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ অন্যান্য কার্যক্রমগুলো পরিদর্শন করবেন।
×