ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিভ্রান্ত এক জঙ্গীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৮ অক্টোবর ২০১৬

বিভ্রান্ত এক জঙ্গীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা

আজাদ সুলায়মান ॥ জীবনে কখনও ভাবিনি, একদিন জঙ্গী হব। যখন জঙ্গী হয়ে উঠলাম-তখনও মনে হয়নি আমি বিপথগামী। কিন্তু যেদিন বাড়িতে র‌্যাব আমাকে খুঁজতে এলো, তখন বুঝলাম আমি সত্যি সত্যিই সর্বনাশা পথের পথিক। আমি এখন অনুতপ্ত- বিভ্রান্তির অন্ধকার জগত থেকে ফিরতে চাই। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারায় আমি কৃতজ্ঞ। এভাবেই জনকণ্ঠের কাছে জঙ্গী হয়ে ওঠার অজানা কাহিনী শোনালেন র‌্যাবের কাছে আত্মসমপর্ণকারী জেএমবি সদস্য আবদুল হাকিম। এখন তিনি ঢাকায় র‌্যাব হেফাজতে। বুধবার বগুড়ায় র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণের পর শাহজাহানপুর ভিহিগ্রামের এই তরুণ এখন সংবাদ শিরোনাম। একই অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করেন আরেক তরুণ বিজয়। দুজনেই র‌্যাবের হেফাজতে নিজেদের ভুল শোধরাচ্ছেন। বলছেন অন্ধকার জীবনে অজানা অধ্যায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে র‌্যাব-১ অফিসের একটি কক্ষে একান্তে কথা হয় হাকিমের সঙ্গে। হাকিম জানালেন, গুলশান হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গীর একজন খায়রুল ইসলাম পায়েলের ইন্ধনে উগ্রবাদে জড়ানোর প্রেক্ষাপট, জেএমবির সদস্যদের সঙ্গে একাধিক গোপন সভায় অংশ নেয়া ও আত্মসমর্পণের নেপথ্য কাহিনী। এখন তিনি অনুতপ্ত। বলেছেন, ওই পথটা ঠিক ছিল না। যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আমি শুরু করতে চাই নতুন জীবন। কথা বলার প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে হয়েছে- সে যা করেছে সবই ছিল ভুল। সেই ভুলের মাশুল তাকে সারাজীবন দিতে হবে কিনা এখন সেটাই তার বড় দুশ্চিন্তা। যদিও র‌্যাব তাকে আশ্বস্ত করছে- স্বাভাবিক জীবন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হবে তাকে। হাকিমের পুনর্বাসিত জীবন দেখে অন্য জঙ্গীরাও ফিরে আসার অনুপ্রেরণা পায়। বগুড়ার শাহজাহানপুর থানার কামারপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমানের চার ছেলের তৃতীয় আবদুল হাকিম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। যৎসামান্য কৃষি জমি। তাতে শাক-সবজির আবাদ আর একটা ফিশারি। তাই দিয়ে টেনেটুনে চলে সংসার। বাবা মা খুব একটা লেখাপড়া জানেন না। সে জন্যই তাদের স্বপ্ন ছিল সবাইকে না পারলেও অন্তত দুটো ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো। সে আশায় আবদুল হাকিমকে প্রথমে স্কুলে দেয়া হয়। কামারপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পর তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত চলে স্বাভাবিক পড়াশোনা। সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। তাকে আরবী লাইনে শিক্ষিত করতে ভর্তি করানো হয় পাশের কুষ্টিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। বছর দুয়েক পর এখান থেকেও রণেভঙ্গ। এবার তার নজর পড়ে পাশের ভিহিগ্রাম এডিইউ সেন্ট্রাল হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। এখানে ভর্তি হন হাকিম। মোটামুটি রেজাল্টও ভাল করেন। বছর পাঁচেক পর ২০১৩ সালে দাখিল পাস করেন। ২০১৫ সালে একই মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেন। আলিম পাসের পর স্বপ্ন তাকে আরও চেপে ধরে। উচ্চ শিক্ষিত হবার বাসনায় হাকিম ছুটতে থাকে এখান থেকে সেখানে। তার বড় ইচ্ছে- ঢাকার একটি নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। তার আগে তিনি ভর্তি হয়ে যান বগুড়া আজিজুল হক ডিগ্রী কলেজে। এখানে ভর্তি হবার পরও তার লক্ষ্য থাকে ঢাকায় ভর্তির। উচ্চশিক্ষা শেষে ভাল একটা চাকরি জুিটয়ে সংসারের হাল ধরে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করাই হাকিমের জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এ সময়েই পরিচয় ঘটে খায়রুল ইসলাম পায়েল নামের সেই দুর্ধর্ষ জঙ্গী সঙ্গে, যে হলি আর্টিজানে নিহত পাঁচ জঙ্গীর একজন। পায়েলের বাড়িও বগুড়ায়। তারা নিয়মিত আজিজুল হক কলেজে আড্ডা দিত। বিশেষ করে ক্যাম্পাসে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে হাকিমসহ আরও কজনের সঙ্গে দ্বীন-দুনিয়ার আলোচনা করতেন। জীবনের পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভ করতে হলে প্রচলিত শিক্ষার বাইরে যেতে হবে। এ ধরনের কথা বলে তাদের প্রলুব্ধ করতেন। এক পর্যায়ে হাকিমকে একদিন ঢাকার মিরপুরে তার এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে নিয়ে আসে। সেখানে তাকে স্বপ্ন দেখানো হয়- গ্রামে ফিরে গিয়ে আর কিছু হবে না। জীবনে সাইন করতে হলে ঢাকায় থাকতে হবে। পায়েল তাকে রঙ্গিন জীবনের স্বপ্ন দেখায়। তার কথায় হাকিমও পুলকিত হয়। বিকশিত জীবনের লিপ্সায় হাকিম তাতে রাজি হয়। বাড়ি যাবার কিছুদিন পর তাকে আবার ঢাকায় নিয়ে আসে পায়েল। এবার তাকে মিরপুর মাজার রোডের একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে তোলা হয়। তারপরে কাহিনী হাকিমের মুখেই শোনা যাক। মিরপুর মাজার রোডের পাশের একটি গলিতে ওই ফ্ল্যাট বাড়ির চতুর্থ তলার একটা রুমে আমাকে উঠানো হয়। প্রথমদিনই ওই বাসায় থাকার আচরণবিধি ও কিছু নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেয়া হয়। যেমন বাসার দরজা জানালা সব সময় বন্ধ রাখতে হবে। বড় ভাইয়েরা সময় সময় দ্বীনি শিক্ষার ক্লাস নিতে আসবে। তাদের কোন কিছুই প্রশ্ন করা যাবে না। বেয়াদবি হয় এমন কিছু করা বা বলা যাবে না। ওরাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির পথ তারাই দেখাতে পারে। সেজন্য তাদের উপদেশ শুনতে হবে। দুনিয়ার কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের কাজ করতে হবে। আল্লাহর আইনটা প্রশ্ন না করার আগে ওই বড় ভাইয়েরাই স্বেচ্ছায় লেকচার দিয়ে বলতেন- দেশে এখন যে আইন আছে তা হচ্ছে তাগুতি আইন। এটা মানুষের রচিত আইন। এতে মুসলমানদের কোন কল্যাণ নেই। প্রকৃত মুমিন কিছুতেই এ আইন মানতে পারে না। আল্লাহর আইন ছাড়া মুক্তি নেই। সে জন্য শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শরীয়া প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বাভাবিক পথে হবে না। জিহাদ করতে হবে। খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইরান সিরিয়ার মতো রাষ্ট্র দখল করতে হবে। সেই দিনগুলো সম্পর্কে হাকিম বলেন, বেশি দিন নয়-মাত্র মাস দুয়েক ছিলাম ওই ফ্ল্যাটে। তিন শিফটে তিন বড় ভাই আসতেন। তাদের বেশ সুশিক্ষিত মনে হয়েছে। সকালে শিক্ষা দেযা হতো তাত্ত্বিক বিষয়। দুপুরে দ্বীন দুনিয়ার মাসালা ও রাতে হাতে কলমে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেয়া হতো। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস সম্পর্কে বলতে গেলে নিজের বিবেকে প্রশ্ন দেখা দিত। এটা তো স্কুল কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা করে। দ্বীন দুনিয়া ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার ক্লাসে কি করে প্র্যাকটিকাল হয়? এমন খটকা লাগত। কিন্তু কৌতূহল থাকলেও প্রশ্ন করা যেত না। জিহাদ সম্পর্কে যখন ক্লাস নেয়া হতো তখন ইসলামের বিজয় গৌরবের সেই বদরের যুদ্ধের পুরো কাহিনী শোনানো হতো। মাত্র কজন সাহাবার কাছে হাজার হাজার কাফের কিভাবে পরাজয় বরণ করেছিল, কিভাবে ইসলামের পতাকা ওড়েছিল, কিভাবে হুজর পাক (দ.)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা দুনিয়ায় ইসলামের বিকাশ ঘটেছিল সে উদাহরণ দেয়া হতো। প্রতিদিনের প্রতিটি ক্লাসের লেকচারের কোন না কোন এক পর্যায়ে বদরের যুদ্ধের উদাহরণ দেয়া হতো। হাকিম বললেন, রাতের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে সামনে আনা হতো চাপাতি আর পিস্তল। কিভাবে কখন চাপাতি ব্যবহার করা লাগে কখন পিস্তল ব্যবহার করা লাগে সেটা ভাল করে বোঝানো হতো। আমাদের বলা হতো-তোমরা যখন কোন মিশনে যাবে- তখন পিস্তল ও বোমা রাখবে আত্মরক্ষার জন্য। চাপাতি দিয়ে শুধু কোপাবে। পারত পক্ষে প্রয়োজন না করলে পিস্তল দিয়ে গুলি করবে না। যদি কোন ব্যারিকেডে পড়ে যাও কেবল তখনই পিস্তল গুলি করে বোমা ছুড়ে ভীতি ছড়িয়ে আত্মরক্ষা করবে। এভাবেই একের পর এক কাজ করতে করতে একদিন সফলতা আসবে। এদেশে কায়েম হবে খেলাফত। তখনই তোমরা সফলকাম মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। হাকিম জানালেন, জিহাদের ক্লাসে বলা হতো- জিহাদে যাওয়ার আগে পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে ইয়ানত সংগ্রহ করতে হবে। প্রতি মাসে বিজয় সংগঠনে ১৫০-২০০ টাকা ইয়ানত হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন, খ্রীস্টান ও হিন্দু পুরোহিতদের হত্যা করতে উৎসাহ দেয়া হয়। প্রতিটি বৈঠকে একজন ‘বড় ভাই’ এসে মগজধোলাই করত। সে কখনও তার নাম বলত না। সেখানে থ্রিমা ও ভিপিএন এ্যাপসের মাধ্যমে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে, তাও শেখানো হতো। জিহাদে চূড়ান্ত অংশ নেয়ার আগে ‘হিজরতে’র পরীক্ষায় দিতে হয়। এক প্রশ্নের জবাবে হাকিম বলেন, ওই বাসায় মূলত বন্দী জীবন যাপন করা হতো। ইচ্ছে করলেই বাইরে যাওযা যেত না। এ নিয়ে মাঝে মাঝে মনে খটকা লাগত বাইরে গেলে সমস্যা কি। একবার বাড়িতে যাবার জন্য ছুটি চেয়েছিলাম। তাতেও বাধা দেয়া হয়। আরও উল্টো বুদ্ধি শেখায়- বলে দাও বাবা মাকে ঢাকায় লেখাপড়া চলছে। মাঝে মাঝে তার মনে সংশয় দেখা দিত- এ পথের পরিণতি কোথায়? এটা কি জিহাদের পথ? কিন্তু ততদিনে ওদের চাপিয়ে জীবনাদর্শেই অভ্যস্ত হতে হয়েছে। তখন আবার মনে হতো এটাই সত্যিকার জীবন। ওই আস্তানা থেকে ফিরে এসে আত্মসমর্পণের বিষয়ে জানতে চাইলে হাকিম বলেন, দু’মাসেই আমি হাঁফিয়ে উঠি। ওসব কিছুই ভাল লাগত না। একদিন ব্যক্তিগত কেনাকাটার কথা বলে ওই বাসা থেকে কোনক্রমে বের হয়ে আসি। সেখান থেকেই গাবতলী গিয়ে সরাসরি বগুড়ার বাসে ওঠি। বাড়িতে আসার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন পায়েল দুই লোকের মাধ্যমে আমাকে খবর দেয়। তার ক্যাম্পে গিয়ে যোগ দেয়ার মেসেজ দেয়। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হইনি। তখন আমাকে হুমকি দেয়া হয়-এভাবে পালিয়ে বাঁচা যাবে না। বাপ-মা, ভাই-বোন শুদ্ধ মেরে ফেলা হবে। এমন হুমকির মুখে আমি ঠিক করি-বিদেশ চলে যাবার। তাড়াহুড়ো করে লাখ তিনেক টাকা যোগাড় করে সিরাজগঞ্জে আমার এক ফুফুর বাড়িতে চলে যাই। ওই ফুফাই আমাকে মালয়েশিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করে। গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার দুদিন আগে আমি মালয়েশিয়া চলে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওখান থেকে ভিসা নকল থাকার অভিযোগে আমাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। দেশে ফিরে আমি আবারও সিরাজগঞ্জে গিয়ে ফুফাকে জিজ্ঞাসা করি কেন এমন করা হলো। সেখানে থাকা অবস্থাতেই ৪ জুলাই শুনতে পাই, গুলশানের ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গীর একজন পায়েলও মারা গেছে। তখন কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাই। কিন্তু একদিন পর আবার বাড়ি থেকে খরব পাঠানো হয়- সরকারী আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর লোকজন বাড়িতে গিয়ে আমাকে খোঁজ করছে। বাবা মাকে ধরার হুমকি দিচ্ছে। তখন টেলিভিশনে দেখি- তোমরা ফিরে আস। র‌্যাবের কাছে ধরা পড়লে বিপদ আছে। প্রাণ যাবে। আত্মসমপর্ণ করলে বাঁচা যাবে। বাড়ির সবাই বলল- আত্মসমপর্ণ করতে। এমন বিশ্বাসেই সরাসরি বগুড়া র‌্যাবের কাছে ধরা দেই। এখন মনে হচ্ছে বেঁচে গেলাম। আফসোস হচ্ছে কেন- পায়েলের পাল্লায় পড়ে বিপথে গিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞ- র‌্যাব ও সরকারের কাছে তারা আমাদের বাঁচার সুযোগ দিয়েছে।
×