ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

দারিদ্র্য বিমোচন ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ অক্টোবর ২০১৬

দারিদ্র্য বিমোচন ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

বাংলাদেশের ৫ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচনকে স্থান দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক আলোচনায় দরিদ্রকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বি¡ক বঞ্চনার প্রতিফলক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের বঞ্চনা জনগণের সেই অংশের ওপর আপতিত হয় যে অংশের নিম্নতম মানের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ বা সম্পদের গম্যতা থাকে না। প্রধানত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দারিদ্র্যকে প্রতিদিন মাথাপিছু ১.২৫ মার্কিন ডলারের (২০০৫ সালের আন্তর্জাতিক মূল্যমানের) চেয়ে কম আয় অর্জন বা ভোগ সক্ষমতাকে নির্দেশ করা হয়। বলা হয় যে, এই অঙ্কের মাথাপিছু আয়ের নিচে যারা অবস্থান করেন তারা জীবনের মৌলিক বস্তুভিত্তিক প্রয়োজন যথা: খাদ্য, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, বস্ত্র, মৌলিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা মেটাতে অক্ষম এবং পরিবহন, জ্বালানি ও যোগাযোগের গম্যতা থেকে বঞ্চিত থাকেন। জাতিসংঘের সহস্র্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যাদি মূলত পৃথিবী থেকে অনুরূপভাবে শনাক্তকৃত দরিদ্রদের দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রযুক্তকৃত সর্বজনীন উন্নয়নের দর্শন হিসেবে ২০০০ সালে গৃহীত হয়েছে। সাম্প্রতিক দারিদ্র্য বিমোচনের দৃষ্টি আকর্ষণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে গণচীন। প্রায় ৩ দশক ধরে চীন বার্ষিক শতকরা ১০ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৮১ সালে সেখানে দৃষ্ট চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা শতকরা ৮৪ থেকে ২০১০-এ শতকরা ১২-এর নিচে নামিয়ে এনেছে। সাম্প্রতিক জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশেও চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০০২-এর ৩৪% থেকে ২০১৫ সালে ১২%-এর নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০২০ সালে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালের সমাপনীতে দেশে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা শতকরা ৮.৯ ভাগে নামিয়ে আনা লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে সমাপ্ত জরিপ অনুযায়ী এই দেশের কয়েকটি এলাকায় চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা ইতোমধ্যে শতকরা ৭%-এর নিচে নেমে গেছে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দারিদ্র্য বিমোচনে এই সফলতাকে বিশেষভাবে প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেছে। (দ্রষ্টব্য, দৈনিক জনকণ্ঠ, ৪/১০/১৬) দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিস্তৃত কার্যক্রম শনাক্ত ও বাস্তবায়ন করা হয়। নিপুণ পরিচালনার স্তোক শুনিয়ে ক্ষমতায় থাকা ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তৎকালীন স্বৈরতান্ত্রিক সরকার এই ধরনের কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় দারিদ্র্য বিমোচনের বিস্তৃত কার্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে। ফলত চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০১১-এর শতকরা ১৬.৫ ভাগ থেকে ২০১৫ সালে শতকরা ১২.৯ ভাগে নেমে এসেছে। এই মাত্রায় নেমে আসা সহস্র্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে বিব্রত দারিদ্র্য বিমোচনের নির্ধারিত লক্ষ্য তাৎপর্যমূলকভাবে মাত্রা অতিক্রম করে গেছে। এই অর্জন পরবর্তী পর্যায়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও প্রক্রিয়া নির্ধারণে পথিকৃতের উপকরণ যুগিয়েছে বলে স্বীকৃত হয়েছে। ৫ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ দেশে দারিদ্র্যের মূল ৮টি কারণ শনাক্তকৃত হয়েছিল : ১. নিচু হারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ২. আয়ের বৈষম্যমূলক বিতরণ, ৩. উৎপাদনশীল সম্পদের মালিকানায় বৈষম্য, ৪. বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব, ৫. জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার, ৬. মানবসম্পদ উন্নয়নের নি¤œ পর্যায়, ৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ৮. গণকৃত্যকাদির সীমিত লভ্যতা। ৫ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে এই শনাক্তকৃত কারণগুলো দূর করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। পরে ২০০২-০৮ সাল পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোন কার্যকর ভূমিকা তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকারের তরফ থেকে নেয়া হয়নি। এর পরে জননেত্রী শেখ হাসিনার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে বিদ্যুত উৎপাদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব প্রসার, মোট জাতীয় উৎপাদন অধিকতর হারে বাড়া, শ্রমঘন শিল্পের বিস্তৃতি কৃষির অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং রফতানির ক্রমাগত বর্ধন ও রফতানিপ্রসূত আয়ের যথাযথ ব্যবহার দারিদ্র্র্র্য বিমোচনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। অধিকন্তু চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত অপেক্ষাকৃত অসহায় লোকগোষ্ঠীর অনুকূলে সরকারের আয় হস্তান্তরমূলক কার্যক্রম এবং লাগসই কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি দারিদ্র্যের অভিঘাতকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উপশম করেছে। ৫ম ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রযুক্ত প্রকল্প ও কার্যক্রমসমূহ বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি সফলতার উপাদান ধরা দেয়। এক. এ দেশে কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ জনগণকে খাদ্য নিরাপত্তা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের আয় বাড়ায় এবং এই প্রক্রিয়ায় কৃষি মজুরকে অধিকতর মজুরি বা আয় প্রদানের ভিত্তি প্রসারিত করে। দেখা গেছে যে, যেখানে দিনপ্রতি সাড়ে ৩ কেজি চাল বা খাদ্যশস্য আহরণ একটি গড় পরিবারকে চরম দারিদ্র্যসীমার ওপরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হতো, সেখানে ষষ্ঠ পরিকল্পনাকালে একজন কৃষি মজুর বা শ্রমিক দৈনিক আয় দিয়ে ১০-১২ কেজি চাল তার পরিবারের জন্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। কৃষি মজুরির এই উর্ধগতি শিল্প ও সেবা খাতে মজুরির পরিমাণ তেমনি লাগসই হারে বাড়িয়েছে। লক্ষণীয় যে, চীনে শিল্প ক্ষেত্রে প্রাপ্ত শ্রম মজুরি প্রায় ৩ দশক ধরে কৃষি ক্ষেত্রে মজুরিকে টেনে তুলেছে, তার পটভূমিকায় বাংলাদেশে ২০০৯-১৫ পর্যন্ত কৃষি মজুরির উর্ধগতি শিল্প ও সেবা খাতের মজুরিকে টেনে তুলতে চমকপ্রদ ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। দুই. যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ এই দশকে একটি একক বাজারে রূপান্তরিত ও উন্নীত হয়েছে। এর ফলে কৃষিপণ্য, মাছ ও মাংসের বাজার স্থিতিশীল হয়ে কৃষক পর্যায়ে অধিকতর উৎপাদিত পণ্য বিনিময়াগার না থাকা সত্ত্বেও কৃষি ফসল এবং মাছ-মাংসের দাম কমিয়ে দেয়নি। অন্যদিকে কৃষি ও অন্যান্য কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিপরীতে অর্জিত আয় কৃষকের ক্রয় ক্ষমতা সার্বিকভাবে বাড়িয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পজাত পণ্যের দাম যথাযথ মাত্রায় উন্নীত রেখে এসব ক্ষেত্রে ক্রমাগত অধিকতর বিনিয়োগ ও উৎপাদনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ভিত্তিতে সৃষ্ট একক বাজার এভাবে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান ও আয় বাড়িয়ে দারিদ্র্যের অভিঘাতকে সীমিত রাখতে বা নিচে নামিয়ে আনতে অবদান রেখেছে। কৃষি ও এসব শিল্পের বিকাশে বিদ্যুত ও জ্বালানির অধিকতর উৎপাদন ও নিপুণতার বিতরণ গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ২০১০ সালে ৫৮২৩ মে ওয়াট থেকে ২০১৫-এ ১৫৪৫৭ মে. ওয়াটে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো দেশের সার্বিক উৎপাদন বর্ধনে শেখ হাসিনার সরকারের এক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হিসেবে কাজ করেছে। তিন. ২০০২-০৮ সালের তুলনায় ২০০৯-১৫ পর্যন্ত অধিকতর রফতানি আয় ও বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত অবাধে রূপান্তরক্ষম অর্থ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমায়নে বেশি হারে বেসরকারী শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রসারণ ও কৃষি যন্ত্রীকরণে এই বিনিয়োগ ফলপ্রসূ হয়েছে-এক্ষেত্রে রফতানি প্রক্রিয়া, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যথাযথ ব্যবস্থাপনা সফলতার ধারক ও বাহক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ব্যক্তি খাতের পরিধি বিস্তারণ, সরকারের আয় বর্ধিতকরণ এবং ব্যক্তি সঞ্চয়ের হারের উর্ধগতি এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। চার. দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম প্রধান প্রতিফলক হিসেবে এদেশে নারীর ক্ষমতায়ন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতা স্মারক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মোট জাতীয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বার্ষিক শতকরা ৭ ভাগ থেকে ৮ ভাগে উন্নীতকরণের কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত ও প্রযুক্ত হচ্ছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদ বাড়ার একটি বড় অবদান কৃষি ক্ষেত্র থেকে উৎসারিত হবে বলে ৭ম পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ২০১৫ সালের বার্ষিক শতকরা ৩ ভাগ থেকে কৃষি উৎপাদন ২০২০ সালে শতকরা ৩.৫ হারে বাড়বে। কৃষি খাতে উৎপাদন বর্ধনে প্রয়োগিত গবেষণা বিস্তৃতভাবে প্রযুক্তিকরণ প্রক্ষেপিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ৫ম ও ষষ্ঠ পরিকল্পনায় কৃষির ওপর যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা অধিকতর গুরুত্ব পাবে এবং তার ভিত্তিতে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য নিরাপত্তা বিস্তৃত ও নিশ্চিত করা হবে। কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল খাতের উৎপাদন বাড়বে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিদ্যুত ও জ্বালানির উৎপাদন ও সরবরাহ সবচেয়ে সহায়ক উপাদান হিসেবে ভূমিকা রাখবে। কৃষির সঙ্গে শিল্প ক্ষেত্রে বেশি বিনিয়োগ ও রফতানিতে অগ্রসরমানতা অধিকতর উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে দৃঢ় ভূমিকা পালন করবে। এর বাইরে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম বাড়িয়ে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটিয়ে দেশব্যাপী শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হবে। কৃষি ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি পাবে এবং ফলত চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে আসবে এবং তাদের প্রতিকূলে দারিদ্র্যের অভিঘাত তাৎপর্যমূলক মাত্রায় কমে আসবে। দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদী সহায়ক শক্তি হিসেবে শিক্ষার সুযোগ ও ব্যবস্থা প্রসারিত এবং স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন করা হবে। যেমনটি ৫ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে অনুসৃত হয়েছিল, ঠিক তেমনভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রসারিত এবং এসব ক্ষেত্রে ইপ্সিত উৎকর্ষ অর্জন করে সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে সমাজে সুযোগের সমতা সকলের জন্য নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতের প্রসারণ এবং অধিকার হিসেবে বিনা বা সহনীয় মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তি , অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পরিচালন, মেধার নিরিখে ব্যয় বহন ক্ষমতা নির্বিশেষে উচ্চ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদে সুযোগের সমতাভিত্তিক দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। এই লক্ষ্যে সামষ্টিক অর্থ-ব্যবস্থাপনার অন্যতম অংশ হিসেবে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য অনুপার্জিত আয় নিরুৎসাহিত এবং উৎপাদনশীলতার অনুকূলে উৎসাহ সংরক্ষণ করে ও বাড়িয়ে যথাযথ নীতির আওতায় দুর্নীতিভিত্তিক সম্পদ ও আয় নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদন ও রফতানিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও ফলদায়ক করা হবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার জন্য সরকারী বিনিয়োগ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ন্যূনপক্ষে শতকরা ৩ ভাগ এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে ও পরিচালনে শতকরা ১.২ ভাগ প্রযুক্ত করা হবে। সমকালে মোট অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদের শতকরা ২ ভাগে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর মধ্যে হস্তান্তরমূলক পরিশোধন হিসেবে বিতরণ করা হয়। বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন এই ধরনের সকল কার্যক্রম সমন্বিতভাবেও বিস্তৃত অবয়বে সামাজিক প্রতিরক্ষণ দেয়ার মৌল কৌশল হিসেবে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তার মৌল কৌশলের আওতায় আনা হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারের রাজস্ব আয় ২০১৫ সালের মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ১০.৮ ভাগ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২০ সালে শতকরা ১৬ ভাগের ওপর নিয়ে যাওয়া হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, বিস্তৃত অবয়বে সামাজিক প্রতিরক্ষণ দেয়া সরকারের আয় না বাড়িয়ে নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে প্রকৃতি দূষণের অভিঘাত থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রতিরক্ষণ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সফল হওয়া সকল প্রকার ত্রাণ কার্যক্রম আরও সমন্বিত সামাজিক প্রতিরক্ষণের মোড়কে সুসংহত করা হবে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সম্প্রতি যেসব ছিটমহল বাংলাদেশের এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তাদের উন্নয়নে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেশের অন্য সকল এলাকার সমপর্যায়ে উন্নীতকরণের কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। তেমনি যেসব জেলায় গড় মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে নি¤œতর সেসব জেলায় বিশেষ কার্যক্রমের আওতায় মাথাপিছু আয় বাড়ানোর কার্যক্রম প্রযুক্ত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা ইতোমধ্যে যথার্থ সেচ ও কৃষি উন্নয়ন এবং আয় হস্তান্তরমূলক কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হয়েছে। এসব কার্যক্রম বিস্তৃত ও অব্যাহত রাখার কার্যক্রম ওই সব এলাকায় দারিদ্র্যকে দূরে সরিয়ে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে আরও সুনিপুণভাবে প্রযুক্ত হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে এসব এলাকায় বিদ্যুত ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, পেছনে পড়া জেলাসমূহের শিল্প উন্নয়নে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ এবং কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট খাতসমূহের প্রসারণের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গৃহীত এসব কার্যক্রম দেশের প্রতি সর্বাত্মক আনুগত্য নিয়ে সমর্থনীয়। বস্তত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দারিদ্র্য বিমোচনমূলক এসব সামগ্রিক কার্যক্রম এর আগে এত গুরুত্ব পায়নি। এই অর্জনের পথিকৃতের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক বার্ষিক অধিবেশনকালীন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্লানেট ফিফটি ফিফটি চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেইঞ্জ’ পদকে ভূষিত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা এই দুটি পদক জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন বলে এসব ক্ষেত্রে মেধা, পরিশ্রম ও সৃজনশীলতা নিয়ে সকলকে একনিষ্ঠভাবে এগিয়ে যেতে হবে। (চলবে) লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×