ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতিত নারীকেই তার বোধ আর শিক্ষায় জাগতে হবে

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ৭ অক্টোবর ২০১৬

নির্যাতিত নারীকেই তার বোধ আর শিক্ষায় জাগতে হবে

কোন দেশের অর্ধাংশ নারী। নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া যেমন দেশের সামগ্রিক অবস্থার মানোন্নয়ন সম্ভব নয় তেমনি সমাজের ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারেও নারীর যথার্থ ভূমিকা অপরিহার্য। দেশ যেমন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নিয়তই এগিয়ে যায়। একইভাবে এমন অনেক সমস্যা থাকে যার থেকে বের হওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তেমনই একটি বহুল আলোচিত সমস্যা ‘নারী নির্যাতন’। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে নারীরা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করছে; সক্রিয় অবদান রাখছে, ফলে দেশের সমৃদ্ধিও নিরন্তর গতি পাচ্ছে। কিন্তু তার পরেও সমস্যামুক্ত হতে পারছে না সমাজ এবং তার সঙ্গে পুরো জনগোষ্ঠীও। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজন তো আছেই। তার ওপর আছে লিঙ্গ বৈষম্য। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে অসহায় এবং নির্বিত্তরাই অসাম্য আর নির্যাতনের শিকার হয়। আর দুর্বল অংশ হিসেবে নারীরা তো অনেকখানিই এগিয়ে। তাই নারী নিগ্রহের ঘটনা সমাজে আজও প্রকট। এখনও বিভিন্ন তথ্য, গবেষণা এবং প্রতিবেদনে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ জানসমক্ষে স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তেমনই একটি জরিপ চালায় বিবাহিত নারীদের ওপর। ‘নারীর প্রতি সহিংসতার জরিপ-২০১৫’ শিরোনামে গবেষণা কর্মটি তথ্য অনুসন্ধানে প্রায় ২১ হাজার ৬৮৮ জন মহিলাকে সাক্ষাতকারের আওতায় আনে। দেশের সাতটি বিভাগীয় শহর, গ্রাম, সিটি কর্পোরেশন এবং এর বাইরের শহরকে এই উপাত্ত সংগ্রহের নমুনা বাছাইয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়। জরিপে বের হয়ে আসে এসব বিবাহিত নারীর প্রায় ৮০ শতাংশই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। ৫ বছর আগে অর্থাৎ ২০১১ সালে এই নির্যাতনের হার ছিল ৮৭ শতাংশ। মাত্র ৭ শতাংশ হার কমলেও নির্যাতনের মাত্রা কমেনি। এ জরিপে সহায়তা করে ‘জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল’। এ গবেষণার বিভিন্নভাবে নারীর ওপর সহিংসতার চিত্র ফুটে ওঠে। নির্যাতনের হার গ্রামের তুলনায় শহরে কিছুটা কম। বর্তমান এবং সাবেক স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মা এমনকি কর্মক্ষেত্রেও নারীরা যেভাবে বৈষম্যের শিকার একইভাবে নির্মমতারও। ১৫ থেকে তার উপরের বয়সী নারীদের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। তথ্যে বেরিয়ে আসে ৮০% নারী শারীরিক, মানসিক কিংবা অন্য যে কোন অত্যাচারের মুখোমুখি হয়। এদের মধ্যে সিংহভাগ নারীই তাদের ওপর আরোপিত নির্যাতন নীরবে, নিঃশব্দে মেনে নেয়। তার মধ্যে আবার অনেকেই জানে না কিভাবে সরকারের হেল্প লাইনের মাধ্যমে এই নির্যাতনের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। তথ্যটি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারীর বেলায় প্রযোজ্য হলেও এ অত্যাচার শিক্ষিত নারীর ক্ষেত্রে কিছুটা কম। কর্মজীবী নারীরাও এই অত্যাচার থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয়। যদিও সংখ্যায় তারা অল্প। সিংহভাগ নারী অত্যাচারিত হন স্বামী কর্তৃক। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য যে, শ্বশুর, শাশুড়ির চাইতেও বেশি নির্যাতিতা হতে হয় কোন নারীকে তার বাবা-মার কাছে। গবেষণায় এসব তথ্য স্পষ্ট হলেও নারীরা পারিবারিক মান সম্মানের কথা ভেবে এসব কথা কাউকে জানাতেও চায় না। আবার অনেকে এও জানে না যে এসব কথা আদৌ কাউকে বলা সম্ভব কিনা। প্রতিবেদন থেকে এই সত্যটাই বের হয়ে আসে যে শিক্ষার অভাবেই নারী জাতির এই দুর্গতির অন্যতম কারণ। নিরক্ষর কিংবা সামান্য অক্ষরজ্ঞান জানা নারীরা তাদের ওপর নির্মমভাবে চাপানো অত্যাচারের মাত্রা নিজেরাই ভাল করে বুঝতে পারে না। তারা মনে করে স্বামী তাদের অভিভাবক, আর সেই কারণে স্বামীর শাসন-শোষণ মানাও স্ত্রীর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। প্রতিবেদনে আরও একটি তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীদের ওপর সহিংসার মাত্রা কিছুটা কম। অর্থাৎ মেয়েরা যদি শিক্ষায় এবং পেশায় নিজেদের জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে পারে তাহলে নির্যাতনের মাত্রা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। অশিক্ষা, নিরক্ষরতা যেমন উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় একইভাবে তা নারীদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকেও নানাভাবে তিক্ততায় ভরে তোলে। শিক্ষায়, পেশায় নিজেদের স্বাবলম্বী করতে না পারলে নারীদের এই অসহায়ত্ব ঘোচার কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং নিজেদের সব ধরনের অত্যাচার-অবিচার থেকে রক্ষা পেতে নারীদেরই সচেতন হতে হবে। তাদের মৌলিক অধিকারকে যথার্থভাবে আদায় করে নিতে হবে। সবার আগে নিজেকে সমাজের একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নারী হিসেবে নয়, মানুষভেবে। দেশ সামনের দিকে নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার ক্রান্তিলগ্নে বিবাহিত নারীদের এই বেহাল অবস্থা কোনভাবেই কাম্য নয়। নারীদের এই একান্ত ব্যক্তিগত, অভ্যন্তরীণ এবং পারিবারিক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে এর প্রতিকারের সমস্ত উপায় নিরূপণ করতে হবে। আন্তঃবিষয়ক এসব সমস্যা গোপন করে অবিচারের মাত্রাকে আরও উস্কে দেয়ার কোন মানে হয় না। নির্যাতনের কারণ এবং ধরন দুটোই সামনে আসা বাঞ্ছনীয়। নির্যাতন যদি আবেগতাড়িতও হয় সেটা কোনভাবেই মানা ঠিক নয়। নিজের সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে নিজেকেই লড়তে হবে। সবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বাণী নিবেদন করতে চাই- ‘যে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পারে না, আইন, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম কেউই তাকে রক্ষা করতে পারবে না।’
×