ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পশ্চিমবঙ্গ ও অসম থেকে আটক হয়েছে

গ্রেফতার ছয় জেএমবি জঙ্গী বড় নাশকতার ছক কষছিল

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

গ্রেফতার ছয় জেএমবি জঙ্গী বড় নাশকতার ছক কষছিল

শংকর কুমার দে ॥ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অসম রাজ্য থেকে বাংলাদেশের তিন ও ভারতের তিন জেএমবির সদস্যসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) মোট ছয় জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। গ্রেফতারকৃতরা বর্ধমান খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের চার্জশীটভুক্ত ও পুরস্কার ঘোষিত আসামি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের নাশকতার ষড়যন্ত্র করেছিল জানিয়েছে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলা, বিশেষ করে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায়, যোগসাজশ ও খাগড়াগড় বিস্ফোরণের কুশীলবদের সঙ্গে গ্রেফতারকৃত জেএমবির সদস্যদের কোন যোগাযোগ আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখছে তারা। বাংলাদেশে গুলশান হামলার পর জঙ্গীবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ার পর অনেক জঙ্গীই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসমসহ বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে আত্মগোপন করে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। ভারতে গ্রেফতার হওয়ার বাংলাদেশের নাগরিক তিন জেএমবির বিষয়ে জানার জন্য কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)ও সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজখবর নিচ্ছে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) সূত্র জানিয়েছেন, ভারতে জেএমবির যে ছয় জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হচ্ছে, আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে এনাম ওরফে কালো ভাই, মাওলানা ইউসুফ ওরফে বক্কর ওরফে আবু খেতাব, জাহিদুল শেখ ওরফে জাফর ওরফে জবিরুল, মোঃ রফিকুল ওরফে মোঃ রুবেল ওরফে পিচ্চি, শহিদুল ইসলাম ওরফে সুরয়ে ওরফে শামীম এবং আবুল কালাম ওরফে করিম। এদের মধ্যে রুবেল, জাহিদুল আর ইনাম বাংলাদেশের নাগরিক বলে জানিয়েছে এসটিএফ। ২০১৪ সালের পর থেকে এসব জঙ্গীরা পলাতক ছিল। রবিবার রাতে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরাম রাজ্যের আইজল থেকে তাদের গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। গ্রেফতার ব্যক্তিদের সবাই জেএমবির সদস্য। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ভারতে নিযুক্ত জেএমবির দুই প্রধানও রয়েছে। কলকাতা পুলিশের এসটিএফের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জেএমবি জঙ্গী সন্দেহে গোয়েন্দারা প্রথমে জাহিদুল শেখ ওরফে জাফর ওরফে জবিরুল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেফতার করে। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকার জাল ভারতীয় রুপী উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পরে জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদুলের দেয়া তথ্য মতো অভিযান চালিয়ে বাকিদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা ৬ জঙ্গীকে কলকাতার বাংকশাল আদালতে তোলা হয়। কলকাতার এনআইএ আদালতে খাগড়াগড় মামলার শুনানির দিন ধার্য আছে। গত ২০ আগস্ট এ মামলার শুনানি শুরু হয়। ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ) এ মামলার তদন্ত করছে। যদিও জেএমবির এ জঙ্গীদের গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) প্রধান বিশাল গর্গ সোমবার কলকাতার লালবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার হওয়া ছয়জন। ওই ঘটনার পর উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল তারা। পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের একাধিক জায়গা থেকে ওই ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের নাম খাগড়াগড় মামলার চার্জশীটে রেখেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তদন্ত সংস্থা এনআইএ ওই ছয়জনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। তিনি জানান, দুদিন আগে অসমের কাছাড়া থেকে একটা জাল নোটের মামলায় কলকাতা এসটিএফ জাবিরুলকে গ্রেফতার করে। তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জাবিরুল জেএমবির সদস্য বলে স্বীকার করে। তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে রবিবার নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে কালামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসটিএফ প্রধান সংবাদ সম্মেলনে আরও জানান, জেএমবির গ্রেফতার ছয় সদস্য সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত। সেই ভাষার অর্থ খুঁজে বের করে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সোমবার তাদের আদালতে হাজির করা হবে বলে জানান তিনি। কলকাতা পুলিশ দাবি করেছে, জেএমবি সদস্য কালাম বাংলাদেশ থেকে আসাম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশ থেকে তাকে কাছাড়ে সংগঠনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ-বাগদা রোডের ওপর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি জায়গা থেকে ইনাম ও রফিককে গ্রেফতার করা হয়। এসটিএফ প্রধান বিশাল গর্গ বলেন, ইনাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জেএমবি ইউনিটের প্রধান। তার বাড়ি বাংলাদেশের জামালপুরে। গ্রেফতার হওয়া রফিকের বাড়িও একই জায়গায়। ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরিতে পারদর্শী তিনি। বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসা জেএমবি সদস্যদের ভারতে থাকার ব্যবস্থা করে দিত রফিক। উত্তর ২৪ পরগনা জেলারই বসিরহাটের নতুন বাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় ইউসুফ ও শাহিদুলকে। ইউসুফের বাড়ি বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে। তার সন্ধান দিতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা। শাহিদুল উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রধান হিসেবে কাজ করত বলে এসটিএফের দাবি। ভারতে বিভিন্ন নাশকতামূলক ছকের মূল পরিকল্পনাকারী তিনি। তার বাড়ি অসমের বরপেটায়। এসটিএফ প্রধান সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গ্রেফতার হওয়া ছয় জেএমবির সদস্যের কাছ থেকে প্রচুর বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, নাশকতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন কাগজপত্র, বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন, প্রায় দুই কেজি সাদা বিস্ফোরক পাউডার, বিয়ারিং-বল, তার কাটা যায় এমন জিনিস ও ব্যাটারি। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রফিকের কাছে কেমিক্যাল কম্পাউন্ডের একটি বই পাওয়া গেছে। ইউসুফ ও ইনামের কাছে পাওয়া গেছে বিস্ফোরক। ইনামের কাছে একটা সাংগঠনিক ছকও পাওয়া গেছে। রফিকের কাছে বাংলাদেশী ট্রেড লাইসেন্সও মিলেছে। জিজ্ঞাসাবাদে ছয়জন স্বীকার করেছে যে একটি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল তারা। বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সন্দেহভাজন জঙ্গী সদস্য রিপন ও খালিদ খুব সম্ভবত ভারতে আত্মগোপন করে আছে। ঢাকার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া সন্ত্রাসী হামলার পর জঙ্গীবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। রাজধানীর কল্যাণপুর, মিরপুরের রূপনগর, আজিমপুর ও নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় সফল জঙ্গীবিরোধী অভিযানে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গীরাসহ নব্য জেএমবির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। নব্য জেএমবির মেরুদ- ভেঙ্গে গেছে। অব্যাহত জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মুখে পলাতক জঙ্গীরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আত্মগোপন করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছে ঢাকার গোয়েন্দারা।
×