ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

সাফল্যের সোনারোদে মেয়েদের ফুটবল

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সাফল্যের সোনারোদে মেয়েদের ফুটবল

সাফল্যের সোনারোদে এখন বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল। সদ্যই দেশে শেষ হওয়া এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্তপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশের কিশোরীরা। কৃঞ্চা, সানজিদা, মৌসুমী, তহুরারা দেখিয়ে দিয়েছে চেষ্টা আর পরিশ্রম করলে অসাধ্য সাধন করা যায়। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন এশিয়ার সেরা আটটি দেশের একটি। তাক লাগানো সাফল্যের পর সবাই বলছেন, এই দলটিকে ঘষেমেজে ঠিক রাখতে পারলে মহিলাদের বিশ্বকাপ ফুটবলেও খেলা সম্ভব। তবে এজন্য অনেক কাজ করতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে)। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়েদের এই অভাবনীয় সাফল্য ধরে রাখার গুরুদায়িত্ব বাফুফের। খেলা শেষ আর বাড়ি ফিরিয়ে দিলে চলবে না। মেয়েদের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে। অনূর্ধ-১৬ দলটির সাফল্যে চারদিকে বইছে প্রশংসা স্রোত। কিন্তু এসব মেয়েদের বেশিরভাগই উঠে এসেছে প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র ঘর থেকে। কারও বাবা রিক্সাচলক, কারও বাবা দিনমজুর। সেসব ঘরের মেয়েরাই ইচ্ছাশক্তি আর সাধনা দিয়ে বাংলাদেশকে ফুটবলবিশ্বে পরিচিত করেছে। রূপকথার সাফল্যের পর বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসব মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে হবে দেশের স্বার্থেই। পেটে ভাত না থাকলে ভাল খেলা বেশি দিন সম্ভব না। সমাজের বিত্তবান ক্রীড়াপ্রেমীদের এগিয়ে আসা উচিত। ক্রিকেটে সাফল্য পেলেই টাকার ছড়াছড়ি। সরকার থেকেও অর্থ পুরষ্কার দেয়া হয়। কিন্তু মেয়েদের ইতিহাস গড়া সাফল্যের পর সরকারের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়েই সব শেষ। কোন অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা নেই। এটা হতাশাজনক। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ‘ভিশন ২০২২’ ঘোষণা করে পুরুষ ফুটবল দলকে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ খেলানোর স্বপ্ন দেখছেন। এটা যে অলীক স্বপ্ন তা প্রমাণ হয়ে গেছে মালদ্বীপের কাছে ৫ গোল হজম করার পর। এ অবস্থা থাকলে দুই হাজার বাইশ কেন, বাইশ হাজার বাইশেও বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না পুরুষ দল। এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। বাফুফে সভাপতির উচিত, পুরুষ বাদ দিয়ে মেয়েদের নিয়ে ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখা। মেয়েরা সঠিক পরিচর্যা পেলে পারবে জোর দিয়ে বলা যায়। অনুর্ধ-১৬ বাছাইপর্বে বাংলার কিশোরীরা এ প্রমাণ রেখেছে আরেকবার। বাংলাদেশের সোনালি প্রজন্মের মেয়েরা ইতিহাস রচনা করেছিল নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে চাইনিজ তাইপেকে হারিয়ে। ওই ম্যাচ ৪-২ গোলে জিতে এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে খেলা নিশ্চিত করে লাল-সবুজের দেশ। ৫ সেপ্টেম্বর গ্রুপের শেষ ম্যাচটা আনুষ্ঠানিকতার হলেও জয় দিয়েই মিশন শেষ করেছে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৬ মহিলা ফুটবল দল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে একতরফা প্রাধান্য বিস্তার করা ম্যাচে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৬ মহিলা ফুটবল দল ৪-০ গোলে পরাজিত করে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে। স্বাগতিকদের হয়ে জোড়া গোল করেন অধিনায়ক কৃষ্ণা রানী সরকার। একটি করে গোল করেন ফরোয়ার্ড আনুচিং মগিনি ও তহুরা খাতুন। এই জয়ে বাছাইপর্বের ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজের দেশের কিশোরীরা এখন এশিয়ার সেরা আটটি দেশের একটি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ার শীর্ষ সাতটি দলের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বে খেলবে বাংলার বাঘিনীরা। বাছাইপর্বে পাঁচ ম্যাচের প্রতিটিতেই জয় পেয়েছে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের দল। কৃঞ্চা, মগিনি, সানজিদা, মৌসুমীরা প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছে ২৬ বার। বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বাংলাদেশ দলকে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন দিচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা। এছাড়া আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) বাংলাদেশ দলকে বিশেষ সংবর্ধনা দেবে। ইতিহাস গড়া এ সাফল্যের নেপথ্য কারিগর কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। দীর্ঘদিন ধরেই অনুর্ধ দলগুলোকে কোচিং করিয়ে চলেছেন তিনি। পাচ্ছেন তাক লাগানো সাফল্যও। সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ছোটনের অধীনেই ব্রোঞ্জপদক জয় করে বাংলাদেশ। এএফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়ন (আঞ্চলিক) আসরে দু’বার চ্যাম্পিয়ন। একবার তৃতীয় হওয়া এবং ফেয়ার প্লে ট্রফি লাভ। এরপর অনুর্ধ-১৬ আসরের বাছাইপর্বেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূলপর্বে উন্নীত। প্রতিটি সাফল্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ছোটনের নাম। বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে আরব আমিরাতেকে হারানোর পর ছোটন বলেন, ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার। চাইনিজ তাইপেকে হারানোর পর যেন আমার খেলোয়াড়রা অতি আত্মবিশ^াসী না হয়, সেজন্য খেলার আগে মেয়েদের বলেছিলাম আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না। ম্যাচে যেভাবেই হোক জেতা চাই। গোলসংখ্যা কোন ব্যাপার না।’ ছোটন আরও যোগ করেন, দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি, এটাই তৃপ্তি। এই জয় বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এজন্য মেয়েদের অভিবাদন। আমাদের মেয়েদের অভিনন্দন জানানোয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। বাফুফেকে ধন্যবাদ তারা এই দলের জন্য সবরকম সহযোগিতা দেয়ায়। বিশেষ করে ধন্যবাদ মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণকে।’ এই আসরের মূলপর্ব আগামী ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হবে থাইল্যান্ডে (প্রথমে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল চীনে)। ওই আসরে অংশ নেবে মোট আট দল। উত্তর কোরিয়া, চীন, জাপান ও থাইল্যান্ড খেলবে সরাসরি। আর বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে খেলবে আরও চার দল। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ কোয়ালিফাই করেছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া এ প্রসঙ্গে ছোটন বলেন, ‘এখন থেকেই বাংলাদেশ দলের ক্যাম্প শুরু করা উচিত। সেই সঙ্গে বেশিসংখ্যক প্রদর্শনী বা প্রীতি ম্যাচ খেলা উচিত। এক্ষেত্রে আমার চাওয়াÑ আমাদের চেয়ে শক্তিশালী দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলা। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই বাফুফে থেকে প্রাথমিক আশ^াস পাওয়া গেছে থাইল্যান্ড বা চীনের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলার ব্যাপারে।’ আগামী সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের চতুর্থ আসর অনুষ্ঠিত হবে ভারতে, আগামী নবেম্বরে। ওই আসরে বাংলাদেশ জাতীয় দলে কজন অনুর্ধ-১৬ দলের খেলোয়াড় থাকবে? ছোটনের ইঙ্গিত, ‘বেশ কিছু খেলোয়াড় থাকার সম্ভাবনা আছে।’ দলের এই সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব ছোটন স্বার্থপরের মতো একাই নিতে চাননি, ‘আমার দুই সহকারী কোচ লিটু এবং তার স্ত্রী অনন্যা দলের জন্য যেভাবে খেটেছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমি স্বভাবে অনেক গম্ভীর ও রাগী। তাই মেয়েরা আমাকে ভয় পায়। তাই কিছু বলতে সাহস পায় না। এক্ষেত্রে লিটু মেয়েদের কাছ থেকে সব কিছু শুনে সেভাবে সমস্যার সমাধান করেছে। তার স্ত্রী কোচ অনন্যা তো মেয়েদের জ¦র হলে তাদের মাথায় পানি পর্যন্ত ঢেলেছে রাত তিনটা পর্যন্ত। এই আসর শুরুর আগে যখন ক্যাম্প আরম্ভ হয়, তখন দলের আট খেলোয়াড় সাংঘাতিক ভাইরাস জ¦রে আক্রান্ত হয়। আমি তো ভয়ই পেয়ে যাই, যদি তারা খেলতে না পারে! অনন্যাই মেয়েদের সেবাযতœ করে ওদের দ্রুত সুস্থ করে তোলে। দলের মিডিয়া ম্যানেজার আহসান আহমেদ অমিতের অবদানও অনস্বীকার্য।’ বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে বাছাইপর্বে অংশ নেয়া দলগুলোও। শেষ দিন আরব আমিরাতের সিরিয়ান কোচ আজম ঘটক বলেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে, তাতে তাদেরই মূলপর্বে যাওয়াটা মানায়। আশা করি সেখানেও তারা ভাল খেলবে। এই দলটার ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল। বাংলাদেশ দলের সানজিদা, স্বপ্না, আনুচিং, কৃষ্ণা এবং গোলরক্ষক মাহমুদার খেলা অনেক ভাল লেগেছে।’
×