ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের জন্য নতুন বিজয়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩১ আগস্ট ২০১৬

বাংলাদেশের জন্য নতুন বিজয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে আপীল বিভাগের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে শহীদ পরিবারের সদস্য, দেশের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনসহ গণজাগরণ মঞ্চ। রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় তারা বছেলেন, এই রায় বাংলাদেশের জন্য নতুন বিজয়। দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন সবাই। পাশাপাশি জামায়াত শিবির নিষিদ্ধসহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন অনেকে। আব্দুল হান্নান ॥ মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল থাকায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেছেন, মীর কাশেমের রায়কে কেন্দ্র করে অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে। আমি বলব ভাইরাসে ধরেছিল। তবে শেষ ভাল যার, সব ভাল তার। আব্দুল হান্নান খান আরও বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিকে ভুল ‘মেসেজ’ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যারা এই চেষ্টা করেছিল তারা মোটেই ঠিক করেনি। মীর কাশেম আলী নিজেও বিত্তবান মানুষ। তিনি লবিস্ট নিয়োগ করে রায় ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তুরিন আফরোজ ॥ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, ‘অসাধারণ ভাল লাগছে। মামলার ধরন আলাদা ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে বিচার প্রক্রিয়ায় তদন্ত ও আইনী লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ ছিল। সব কিছু মোকাবেলা করে আজ কাক্সিক্ষত রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। তবে শেষ অবধি রিভিউ রায় বহাল থাকায় আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে।’ ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, মীর কাশেম আলী জামায়াতে ইসলামীর প্রধান অর্থলগ্নীকারী ব্যক্তি। তিনি দেশী-বিদেশী লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন। রায় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চ্যালেঞ্জ সব সময়ই ছিল। সে কারণে আমরা রায় নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। ‘দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের দাবি’ ॥ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রীমকোর্ট খারিজ করে দেয়ার পর তার ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপীল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই দাবি জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, রায় হয়েছে, ভাল হয়েছে। বিচারকরা যা ঠিক মনে করেছেন সে অনুযায়ী রায় দিয়েছেন। এখন রায়টা আমরা দ্রুত কার্যকর চাই। বিষয় হচ্ছে, রায় যদি আবার ঝুলিয়ে রাখে দু’মাস যেহেতু আমরা দেখেছি রিভিউতে সময়ক্ষেপণ হয়েছে অযথা। এবার সেটা যেন না হয়। একইসঙ্গে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধের বাকি মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকরের দাবি জানান একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর। কাশেমের ফাঁসি দ্রুত হলেই ভাল- মুক্তিযোদ্ধা জসিমের বোন ॥ একাত্তরে চট্টগ্রামের কুখ্যাত ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন ও হত্যার দায়ে আল বদর নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-ের চূড়ান্ত রায় এসেছে, সেই জসিম উদ্দিনের মামাতো বোন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ মঙ্গলবার মীর কাশেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় সাক্ষ্য দেয়া হাসিনা খাতুন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রায় বহাল আছে, রায় কার্যকর হলে আমরা খুশি হব। দ্রুত ফাঁসি হয়ে গেলেই ভাল হয়। একাত্তরের নবেম্বর মাসে ঈদ-উল-ফিতরের পরদিন চট্টগ্রাম নগরীর বেপারীপাড়ায় তার বাসায় এসে পোলাও খেতে চেয়েছিলেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম। ফুফাতো ভাইয়ের আবদার মেটাতে তাকে পোলাও রান্না করে খাওয়ান তিনি। ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পরই জসিমকে ধরে নিয়ে যায় আল-বদর বাহিনী। এ মামলায় প্রসিকিউশনের আনা একাদশ অভিযোগে বলা হয়, মীর কাশেমের পরিকল্পনায় এবং তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নবেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়। হাসিনা খাতুন জানান, তখন জসিমের বয়স ছিল সতের-আঠারো। সন্দ্বীপে থাকতেন তিনি, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জানান, ডালিম হোটেলে আটকে রেখে জসিমকে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। একদিন নির্যাতন করার পর জসিম একটু পানি খেতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা তা দেয়নি। সেখানে থাকা আরেক বন্দী এ্যাডভোকেট শফিউল আলম জমিয়ে রাখা হাত ধোয়া পানি জসিমকে খেতে দিয়েছিলেন সেদিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শফিউল আলমসহ আরও কয়েকজন ডালিম হোটেল থেকে মুক্তি পান। তখন শফিউলের কাছ থেকেই জসিমের সেই নির্যাতনের কথা জানতে পারেন বলে জানান হাসিনা খাতুন। সেই সময়ের চট্টগ্রামের ত্রাস মীর কাশেম অর্থবিত্তে এখনও অনেক ‘শক্তিশালী’ মন্তব্য করে জসিমের এই বোন বলেন, উনি ধনী মানুষ, অর্থ আছে। আপীল আর রিভিউ মিলে উনি যে সময় পেয়েছেন, ততখানি আর কেউ পায়নি। শেষ বিচারেও মীর কাশেমের প্রাণদ- বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে হাসিনা খাতুন বলেন, আমি ভাই হত্যার বিচার পেয়েছি এবং এটা বহাল আছে। দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর হবে বলে আশা করি। একাত্তরের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ‘সঠিকভাবে’ শেষ করার দাবি জানান তিনি। সেক্টর কমান্ডাস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ ॥ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কুখ্যাত দোসর মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় খারিজ হওয়ায় সেক্টর কমান্ডাস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ফোরাম মনে করে এই রায় বাংলাদেশের জন্য নতুন বিজয়। ফোরাম বিশ্বাস করে, এই রায়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরেরা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যে নির্মম মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েছিল তার বিচার হয়েছে। নিহত ও আহত মানুষের পরিবারগুলো সুবিচার পেয়েছে। শেষ সময়ে মরণ কামড় দিতে পারে জামায়াত- ইমরান ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল থাকায় উল্লাস প্রকাশ করেছে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে জামায়াত নিষিদ্ধের পথে বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার পরপর রাজধানীর শাহবাগে মঞ্চের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন। রায়কে কেন্দ্র করে সকাল থেকে প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান নেয় মঞ্চের নেতাকর্মীরা। তারা মীর কাশেমের ফাঁসির দাবি জানিয়ে সেøাগান দিতে থাকে। ইমরান বলেন, রায়ে ফাঁসি বহাল আছে এটি কতটা আনন্দের ভাষায় প্রকাশের নয়। পাঁচ মাস ধরে রিভিউ খারিজের অপেক্ষায় ছিলাম। আর কোন যুদ্ধাপরাধীর এতো সময় লাগেনি। মীর কাশেম তার অর্থবিত্ত, প্রভাব ব্যবহার করে রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ফাঁসি বহাল থাকায় জাতির শঙ্কা দূর হলো। এই রায়ের মধ্যদিয়ে জামায়াত নিষিদ্ধের পথে বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে, মত দেন ইমরান। তিনি বলেন, ন্যায্য বিষয় জয়ী হলো, অন্যায় পরাজিত হলো। রায় কার্যকরের পরে ১৯১ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজ শুরু করবে সরকার এমনটাই আশা করি। ইমরান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অনেক সময় গেছে। এখন আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতে হবে। তাই আর কালক্ষেপণ না করে, ফাঁসি কার্যকর করতে হবে বলে আশা করি। শেষ সময়ে মরণ কামড় দিতে পারে জামায়াত সতর্ক থাকতে হবে সেটি নিয়েও। কারণ তারা দেশের মানুষের টাকা লুট করে ধনী হয়েছে। এর প্রভাব তারা ব্যবহার করতে চাইবেই। যা বাজেয়াফত করাও এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, ন্যায্যতা জয়ী হলো, অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি পরাজিত হলো। জামায়াত, জঙ্গীবাদ ও নাশকতায় প্রধান অর্থের যোগানদাতা যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের রায় কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। রাজাকার মীর কাশেমের রায় কার্যকর ও জামাত নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করবে নতুন এক বাংলাদেশ; কলঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ। বাঙালীর দীর্ঘ ৪৫ বছরের অপেক্ষার বাংলাদেশ। ওয়ার্কার্স পার্টির সন্তোষ ॥ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, আলবদর নেতা, চট্টগ্রামের কসাই জামাতের কর্ম পরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ বহাল রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। এক বিবৃতিতে পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুল হাসান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায় ছিল জাতির কাছে প্রত্যাশিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনীর তিন নম্বর নেতা মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামে মানুষ হত্যায় কসাই পরিচিতি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই কুখ্যাত অপরাধী আত্মগোপনে চলে যায়। ’৭৭ সালে জিয়ার সামরিক শাসন আমলে কাশেম আলীর হাত ধরেই ছাত্র শিবির প্রতিষ্ঠা পায়। যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- প্রদানের মধ্যে দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি দায় শোধে দেশ আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। অবিলম্বে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া কুখ্যাত আল-বদর নেতা জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ বহাল রাখায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এক বিবৃতিতে এই রায় দ্রুত কার্যকর এবং অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, মীর কাশেম আলী একাত্তরে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের সঙ্গেই শুধু যুক্ত ছিলেন না, তিনি ছিলেন আল-বদর বাহিনী তথা যুদ্ধাপরাধীদের নেতা। স্বাধীনতার পরেও তিনি যুদ্ধাপরাধীদের নেতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা তৎপরতা চালিয়েছেন। তার মৃত্যুদ-াদেশ ন্যায়বিচারের পক্ষে। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ব্যক্তির পাশাপাশি যেসব রাজনৈতিক দল ও শক্তি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। আদালত কর্তৃক ঘোষিত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
×