ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাল্টে গেছে জীবন যাচ্ছে বিদেশে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩০ জুলাই ২০১৬

পাল্টে গেছে জীবন যাচ্ছে বিদেশে

সমুদ্র হক ॥ আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে...। শ্রাবণের বাদল দিনেও গ্রামের নারীর একদ- ফুরসত নেই। কেউ কাশবনে গিয়ে কেটে আনছে কাঠি। কেউ বাড়ির উঠানে বসেই শুরু করেছে কাশের কাঠির নিখুঁত বুনন। টাপুর টুপুর বৃষ্টির ছন্দেও এরা কাঠি নিয়েই নেচে ওঠে। শরতের প্রতীক কাশবন। শ্বেত শুভ্র কাশ ফুলের নাচন এবার শ্রাবণেই শুরু হয়েছে। পাল্টে যাওয়া জলবায়ুর পাকে পড়েছে বনফুল। বাদ পড়েনি কাশবনও। কাশের কাঠি গ্রামীণ নারীর ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে। এই কাঠির তৈরি ডালা ধামা ডাবর শোপিসসহ নানা হস্তশিল্প দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। গৃহস্থ বাড়িতে ধান রাখার মাটির ডাবর ও গোলার স্থানে বড় আসন করে নিয়েছে কাশের কাঠির পরিবেশসম্মত এই ডাবর। এছাড়াও ঘর গেরস্তালির নানা উপকরণ তৈরি হচ্ছে এই কাঠি দিয়ে। এই কাশবন বগুড়ার যমুনা ও বাঙালী তীরের ধুনট সারিয়াকান্দি সোনাতলা এলাকা এবং চরগ্রামে মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ে সঙ্গী হয়েছে। একদা যে কাশবন ছিল শুধুই প্রকৃতির শরতের সৌন্দর্যের প্রতীক এই কাঠি এখন পথ দেখিয়েছে আয়ের। কাশবন যে আয়ের উৎস হতে পারে তা পঞ্চাশের দশকের শুরুতে বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার পথের পাঁচালী ছবিতে দেখিয়েছেন। যারা এই ছবি দেখেছেন তাদের মনে পড়বে কাশবনের ভেতর দিয়ে অপু আর দুর্গার কিশোর প্রণয়ের মিষ্টি ছুটোছুটির দৃশ্য। বনের কিছু কাশ ও কাঠি কেটে নেয়ার পর দৌড়াতে অসুবিধা হচ্ছিল। পরের দু’তিনটি শট পরই গ্রামীণ জীবনে কাশের কাঠিতে উপকরণ তৈরি দেখানো হয়। পঞ্চাশের দশকে বরেণ্য চলচ্চিত্রকার যে পথ ছায়াছাবিতে দেখিয়েছেন একবিংশ শতকের এই উপমহাদেশে সেই কাঠি গ্রামীণ জীবনমান উন্নত করেছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার মহিপুর গ্রামে কাশের কাঠি দিয়ে নানা ধরনের হস্তশিল্প তৈরির এক কলোনি গড়ে উঠেছে। গ্রামের জোলেখা বেগম জানালেন, যমুনা তীরের বিশাল এলাকা জুড়ে বর্তমানে কাশকাঠির চাষ হচ্ছে। একটা সময় প্রকৃতি থেকেই কাশবন তৈরি হয়ে শরতের পরে আপনা আপনি বিলীন হয়ে যেত। বর্তমানে নদী তীরের এলাকার কাশবন লালন করে লোকজন। অনেক কৃষক অর্থকারী কাঠি হিসাবে পাটের মতো কাশ চাষও করে। এই বন থেকে কাশকাঠি কেটে পাইকারি ও খুচরা দরে বিক্রি করা হয়। যা কিনে নেয় গ্রামের নারীরা। ধুনটের গোসাইবাড়ি ভা-ারবাড়ি সারিয়াকান্দির ধরাবর্ষা বোহাইল সোনাতলায় বাঙালী নদী তীরের হরিখালি এলাকার অনেক মানুষের জীবিকা এনে দিয়েছে এই কাশ। ধুনটের মহিপুরের সাধনা বেগম জানালেন, স্থানীয় হাট বাজারে কাশকাঠির তৈরির নানা সামগ্রী বিক্রি করা হয়। এইসব পণ্য ঘরে ঘরে যাওয়ার পর চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরের ব্যবসায়ীরা কাশকাঠির তৈরি নানা পণ্যের অর্ডার দিচ্ছে। এইসব পণ্য বিদেশেও যাচ্ছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে যেমন বেতকাঠির তৈরি নানা ধরনের হস্তশিল্প বানানো হয় তেমনভাবেই উত্তরাঞ্চলে কাশকাঠির তৈরি হস্তশিল্প তৈরি হচ্ছে। বড় মাঝারি ডালা, ধামা, খাবার টেবিলে ফল ফলাদি রাখার ছোট নক্সা করা ডালা, ঘর সাজানোর শোপিস, ঘরের ভেতরের পার্টিশনসহ নানা সৃষ্টিশীল জিনিস তৈরি হচ্ছে কাশকাঠিতে। সাধনা, জ্যোৎস্না আছিয়া বললেন, বছর চারেক আগে তারা গোসাইবাড়ি থেকে কাশ কেটে এনে নিজেরাই ডালা বানানো শুরু করেন। একটা সময় গৃহস্থ বাড়ির লোকজন ধান রাখার বড় ডাবর বানানো যায় কিনা তা জানতে চায়। পরে কাশের শক্ত কাঠি দিয়ে বড় ডাবর ও ধামা বাননোর পর দশ গাঁয়ের গৃহস্থ ও মাঝারি কুষক অর্ডার দিলে বানিয়ে দেয়া হয়। ঘর গেরস্তালির জিনিসপত্র তৈরির পাশাপশি শোপিস বানানো শুরু হলে একটি প্রতিষ্ঠান নারী উন্নয়নে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠানটি নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ন্যায্য মজুরির ব্যবস্থা, পরিবেশ সচেতনতা, নারী-পুরুষ সমতা ইত্যাদি বিষয় কর্মসূচীতে নিয়েছে। বিদেশে রফতানির বিষয়েও তারা পরামর্শ দেয়। এলাকার এক শিক্ষক জানান, এই কাশবন এখন আর শরতের সৌন্দর্য নয়। এই উদ্ভিদ এখন গ্রামীণ জীবনমান উন্নত করেছে। করে দিয়েছে আয়ের পথ। বিশেষ করে নারী উন্নয়নে বড় অবদান রেখেছে এই কাশবন।
×