ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেই বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা আব্দুর রউফের নাতি সেহজাদ

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৩০ জুলাই ২০১৬

সেই বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা আব্দুর রউফের নাতি সেহজাদ

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গী সেহজাদ রউফ অর্ক ওরফে মরক্কোর দাদা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রউফ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিএফআই (বর্তমান ডিজিএফআই) প্রধান ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির হামলার ঘটনায় যৌথবাহিনীর অভিযানে নিহত নিবরাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন অর্ক। এদিকে অর্ক যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী বলে তার বাবা এক মার্কিন পত্রিকায় প্রকাশ করলেও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার পরিবার দাবি করেছিল, গত ফেব্রুয়ারি থেকে অর্ক নিখোঁজ ছিলেন। তার বাসা ছিল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় (বাসা-৩০৪, রোড-১০, ব্ল-সি)। তার নিখোঁজের ঘটনার পর ভাটারা থানায় একটি জিডি করে তার পরিবার। জিডি নম্বর-৩৯২। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার সময় আব্দুর রউফ ডিএফআই (বর্তমান ডিজিএফআই) প্রধান থেকে পাকিস্তান প্রীতির দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন। এমনকি ওই সময়ে কর্নেল জামিল আহমেদের (মরণোত্তর পদোন্নতি পাওয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা থাকলেও সময়মতো দায়িত্ব হস্তান্তর না করায় ইতিহাসের পাতায় বারবারই তার নাম ‘বিতর্কিত’ সেনাকর্মকর্তা হিসেবেই হাজির হয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে তার সখ্য ছিল সবসময়ই। জিয়ার শাসনামলে ডিএফআইকে ডিজিএফআই করা হলে কে এম আমিনুল ইসলামকে পরিচালক পদে দেয়া হয়। এর পরপরই অভিযোগ এনে তাকে সেখান থেকে সরানো হলে আব্দুর রউফ পরিচালকের দায়িত্ব পান। এ বিষয়ে ২০১০ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব) কেএম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে কোন এক সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একজন এনসিও (নন কমিশনড অফিসার) সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের লিফলেটসহ ধরা পড়েন। তখন আমি তখনকার প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী প্রফেসর নুরুল ইসলামকে লিফলেটটি সম্পর্কে জানানোর জন্য লিফলেটসহ তার কাছে যাই। তারপর আমরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করি। প্রেসিডেন্টকে আমরা অনুরোধ করি, সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট গঠনের প্রস্তাবটি তিনি যেন যত দ্রুত সম্ভব পাস করেন। যত দ্রুত এটা করা যাবে তত দ্রুতই এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যাবে। তিনি বলেন, আর প্রস্তাবটি পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিএফআইকে আর্মি হেডকোয়ার্টারের অধীনে দেয়ার জন্যও প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণ নীরবতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শফিউল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রউফ কি তোমাদের ইন্টেলিজেন্স এ্যাফেয়ার্স সম্পর্কে অবহিত করেন না? রউফ তখন ছিলেন ডিএফআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল। শফিউল্লাহ তখন বঙ্গবন্ধুকে এনসিও’র কাছ থেকে উদ্ধারকৃত লিফলেটটি দেখান। তিনি নিশ্চিত নন যে, বঙ্গবন্ধুকে রউফ এই লিফলেটটির সম্পর্কে অবগত করেছেন কিনা। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সাংবাদিকদের জানান, একের পর এক বের হয়ে আসছে আব্দুর রউফের নাতি, কুখ্যাত মোনায়েম খানের নাতিরা এসব জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত হয়েছে। একবারের মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নন। তার আদর্শে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু একবারের রাজাকার আজীবন রাজাকার। বংশ পরম্পরায় তাদের এই আদর্শ পরিবাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এই আব্দুর রউফ জিয়ার মদদপুষ্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে এসব পাকিস্তানপন্থীরা জায়গা করে নিয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন শাহরিয়ার কবির। জানা যায়, রাজধানীর কল্যাণপুরে মঙ্গলবার ভোরে পরিচালিত অপারেশন স্টর্ম ২৬-এ নিহত জঙ্গী সেহজাদ রউফ অর্কের বাবা তৌহিদ রউফও ছিলেন সেনাবাহিনীর ঠিকাদার। এমনকি অর্ক নিজেও সেই অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে আসীন ছিলেন। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার পুলিশের অভিযানে নিহত অর্ক যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী বাংলাদেশী। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অস্ত্রব্যবসার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি নিউ ভিক্টর লিমিটেড (এনভিএল) নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ সালে তার বিতর্কিত দাদা আব্দুর রউফ গড়ে তুলেছিলেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন নথি (৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯) অনুসারে, ১৯৭৭ সালের ৬ এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আব্দুর রউফ এনভিএল গড়ে তোলেন। তার ছেলে তৌহিদ রউফ ১৯৮৮ সাল থেকে এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। আর অর্ক এখানে পরিচালক পদে ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় নিহত সেহজাদ রউফ অর্কের জীবন বৃত্তান্ত থেকে তার কোম্পানির কাজ সম্পর্কে জানা যায়। তিনি লিখেছেন, আমরা (এনভিএল) এই ব্যবসা ক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরোনো কোম্পানি। আমরা বিদেশ থেকে (চীন, ইংল্যান্ড, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, কোরিয়া, সাউথ আফ্রিকা) পুলিশ, আর্মি, র‌্যাব, নৌবাহিনীর কাছে টেন্ডার অনুযায়ী সেনা প্রতিরক্ষার সরঞ্জামাদি সরবরাহ করি। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির হামলার ঘটনায় যৌথবাহিনীর অভিযানে নিহত নিবরাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন অর্ক। অপরদিকে জঙ্গী আস্তানায় নিহত ছেলে অর্কের বিষয়ে ২৭ জুলাই তার বাবা তৌহিদ রউফ এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, সেজাদের জন্ম বাংলাদেশেই। ১৯৯৯ সালে তারা পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। পরে তৌহিদ ছাড়া পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়ে সান ফ্রান্সিসকোতে বসবাস শুরু করেন। এছাড়া ইলিনয় ও ক্যালিফোর্নিয়ায় কাটিয়েছে। তিনি বলেন, নিখোঁজ হওয়ার আগে কোন চিহ্ন বুঝতে পারেননি তারা। সেহজাদের মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তারা ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন বলে তৌহিদ রউফ ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর ২০১০ সালে ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে পাস করে সেহজাদ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। মা মারা যাওয়ার পর তিনি বদলে যেতে থাকেন বলে এক স্বজন কলকাতা টেলিগ্রাফকে জানান। গত ২৬ জুলাই ভোরে কল্যাণপুরের এক বাড়িতে সন্দেহভাজন জঙ্গীদের আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্টর্ম ২৬-এ অভিযানে আটজনের সঙ্গে সেহজাদ রউফ অর্ক ওরফে মরক্কোর মৃত্যু হয়। পরদিন তার বাবা তৌহিদ রউফ যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের লাশ শনাক্ত করতে গেলেন, তখন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক কর্মকর্তাও তার সঙ্গে ছিলেন। এদিকে বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র জন কিরবিকে যখন এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো, তখন তিনি বলেন, ঢাকায় পুলিশের অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক নিহত হওয়ার বিষয়টি আমি খবরে দেখেছি। এরপর তদন্ত ও নিহতদের পরিবারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কথা বলে আর কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন তিনি। আমরা জানি যে এ বিষয়ে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত চলছে। তাই আমি বলব, এ বিষয়ে আরও তথ্যের জন্য আপনাদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা উচিত। একজন সাংবাদিক সেহজাদের মার্কিন নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বললে কিরবি বলেন, আমি কেবল এটুকু নিশ্চিত করতে পারি, ঢাকায় পুলিশের অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক নিহত হওয়ার খবর আমরা দেখেছি। আপনারা কি বিষয়টি খতিয়ে দেখেননি?, এমন প্রশ্নে কিরবি বলেন, “যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পরিবারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কথা বিবেচনা করে... আমরা আর কোন মন্তব্য করতে চাই না।
×