ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

কিভাবে শেষ বিদায় বলব দাদা?

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২৯ জুন ২০১৬

কিভাবে শেষ বিদায় বলব দাদা?

কোথা থেকে শুরু করব শেষের গল্প? আমরা তখন যৌবনে পা রাখছি। মাথা ঘুরছে কবি হবার পোকা। স্বাধীন দেশের নবীন ছড়াকার আমরা। অজান্তেই ছড়ার ইতিহাসে নাম লেখা আমাদের আড্ডা ও সাহিত্যে পা রাখার জায়গা হলো ফুলকি। এর একটি ছোট ঘরে আমরা মিলিত হতাম অচিরা পাঠচক্রে। এখানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সুদর্শন গৌরকান্তি চমৎকারভাবে কথা বলার এই অগ্রজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগেনি আমার। হয়ত আমার বেশি কথা বলা অথবা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আমার কোন অগ্রজ নেই এভাবেই গড়ে উঠেছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। তখন তাঁর জীবন সংগ্রামের চূড়ান্তপর্ব চলছিল। বিধবা মায়ের মেধাবী ছেলেটির চট্টগ্রাম শহরে মাথাগোঁজার ঠাঁই ছিল না। বাড়তি উপার্জনের জন্য পার্টটাইম লাইব্রেরিয়ানের কাজ করতেন ফুলকিতে। থাকতেন সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের কাগজ জমানার ছোট ঘরে। যতদূর মনে পড়ে আমি দু’একবার সেখানেও গিয়েছি। ছোট একফালি ঘরে কাগজের স্তূপের ভেতর থাকতেন দাদা। কিন্তু মুখের হাসি আর সাহেবদের মতো চুলে তিনি সবসময় রাজকীয়। আমরা যখন ছেঁড়া কাগজে, কখনও সিগারেটের প্যাকেটে, কখনও অন্য কিছুতে লিখে কিছু একটা পড়তে নিয়ে আসতাম, দাদা আনতেন চমৎকার করে গুছিয়ে। জীবনের এক দীর্ঘ সময় লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন তিনি। তখনকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মানুষদের কাছে অতিপরিচিত এই মুখ একদিন তার প্রাপ্য পেল ঠিকই। সরকারী চাকরি বিসিএস পাসের পর তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে চলে গেলেন ঢাকায়। সরকারী চাকরিতে আমলা হবার আলাদা একটা মজা আছে। সেটা এক ধরনের স্বস্তি শান্তি আর নিরাপত্তা দেয়। থাকে তোষামোদি চামচাদের ভিড়। এভাবেই বৃত্তবন্দী হয়ে পড়ে সে মানুষটি। ইনি পড়েননি। শুরু থেকে শেষ অবধি লড়াই করে গেছেন। লেখালেখির লড়াই। হেন বিষয় নেই যা নিয়ে লেখেননি। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে শান্তি বলে কিছু নেই। থাকলেও তা কচুপাতার পানির মতো। সঙ্গে আছে হত্যা মারামারি সন্ত্রাস আর রক্তপাত। আজকাল আর কেউ এসবের বাইরে চিন্তা করতে পারে না। এমন দেশে হাসির কোন জায়গা নেই। দাদা সেই জায়গাটা আগলে রেখেছিলেন। মিডিয়ায় তাঁর লেখার এক বিশাল অংশজুড়ে আছে রম্য লেখা। এত রম্য কথনের রসদ কোথায় পেতেন জানি না। অথচ তাঁর জীবন ছিল বেদনার চাদরে মোড়া। জীবনে যতটা ওপরে উঠেছিলেন ততটাই নীল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছিলেন অকালে। আত্মহননে হারিয়েছিলেন বিধবা মাকে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা : ‘আমারে পাছে সহজে বোঝ তাইতো এতো লীলার ছল/ বাহির যার হাসির ছটা ভেতরে তার চোখের জল।’ দাদার জীবনের এসব ঘটনার পর আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। একটুও বুঝতে দেননি। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেন যেন কিছুই ঘটেনি। এই সেদিন ভয়ানক এক দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গু হবার অবস্থা তাঁর। সেদিনও ফোন করে শুনলাম মিতবাক মানুষের সাবলীল কণ্ঠ। আমি উল্টো বলছিলাম এটা কোন স্যাবোটাজ কিনা। উড়িয়ে দিয়ে বললেন, তেমন কিছু তখনও মনে হচ্ছিল না তাঁর। এমন একজন সদালাপী সজ্জন ভদ্র মানুষ এখন পাবেন কোথাও? তাঁর সবকিছুতে ছিল রুচির ছাপ। যারা তাঁকে চেনেন একবার কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন তারা জানেন কেমন মানুষ ছিলেন তিনি। সেই কবে ইন্দোনেশিয়া ঘুরে থেকে যাওয়া ডলার নিয়ে এসেছিলেন অফিসে তখন যেমন সাধারণ, এরশাদ পতনের পর প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের পিএস দাদা ঠিক সে রকম স্বাভাবিক। আমি দেখেছি তাঁর আজিমপুরের বাসায় নিশ্চল অবিচল একজন মানুষকে। রাষ্ট্রীয় দুর্যোগেও যিনি তাঁর মেধা মননের ব্যবহার করতে ভোলেননি। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পিএস তার পতনের পরপর গল্প লিখলেন সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন নামে। আমি বলব কিছুটা প্রচারবিমুখ ছিলেন তিনি। সৌজন্যে অমায়িক এই মানুষটি মূলত নিভৃতচারী বলেই শেষ বিদায়ও নিলেন নীরবে। সকালবেলা অফিসে যাবার পথে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর করুণ খবরটি আমাকে নিয়ে গেছিল সুদূর অতীতে। যেখানে তিনি সবসময় আমাদের অগ্রজ। আমাদের দাদা। যে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করে ফিরত বলত, দাদা আপনাকে সত্যি ভালবাসে। সে তো আমি টের পেতাম-ই। ঢাকার কত কাগজের কত মিডিয়ার মানুষরা বলেছে। বন্ধুরা বলেছে। আমার মনও বলেছে সবসময়। তাই তো আমি আজ আপনজন বিয়োগের মতো ব্যথায় নীল। রণজিৎ বিশ্বাসের যাবার সময় হয়নি তবু চলে গেলেন আমার মতো অনুজদের একা করে দিয়ে। শেষ বিদায় আমি বলব না। বলব যেখানে আছেন সদাআনন্দে থাকবেন দাদা।
×