হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট ‘এল নিনো’র প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া থেকে পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। পাল্টে দিয়েছে সামগ্রিক আবহাওয়া পরিস্থিতি। ভ্যাপসা গরমে তাই রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা। কাঠফাটা তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র প্রভাবে মাঝে কয়েকটি দিনের জন্য স্বস্তি এলেও ফের একই চিত্র। শুধু সমুদ্র উপকূলীয় চট্টগ্রাম, খুলনা কিংবা সাতক্ষীরা নয়, হাওয়া গরম হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশে। উপকূলজুড়ে বয়ে চলেছে লু হাওয়া। উত্তরাঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। খুব শীঘ্রই এ অবস্থার উন্নতির লক্ষণ নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর। এদিকে, তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিংও। ফলে জনজীবনে কষ্ট আরও বেড়েছে।
‘এল নিনো’ মানে বায়ুম-লীয় ও গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের সমুদ্রগুলোর মধ্যে একটি পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। প্রতি তিন থেকে আট বছরে স্বাভাবিক নিয়মে এ পরিবর্তন দেখা দেয়। এর সঙ্গে বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের যোগ থাকে। স্বাভাবিক পরিক্রমন অনুযায়ী ‘এল নিনো’র অবস্থান এখন প্রশান্ত মহাসাগরে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনহেতু ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হয়ে থাকে, যার ফলে প্রাদুর্ভাব ঘটে নানা ধরনের রোগের। আর সাগরের জল উত্তপ্ত হয়ে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মৎস্যসম্পদ। উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে মাছগুলো চলে যেতে বাধ্য হয় অনেক গভীরে। এতে জালে মাছ ধরা পড়ে না। শুধু তাই নয়, এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাছসহ জলজপ্রাণী মারাও পড়ে। হঠাৎ করে সাগরে জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়া কমে যাওয়ায় ধারণা করা যায় যে, ‘এল নিনো’র প্রভাব বেশ ভালই পড়েছে।
আবহাওয়া অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সাগরে এখন কোন নিম্নচাপ কিংবা লঘুচাপ নেই। গত কয়েকদিন ধরে যে তাপমাত্রা বিরাজ করছে তাও খুব বেশি নয়। বরং বাংলাদেশে চলতি মৌসুমে এটিই স্বাভাবিক তাপমাত্রা। কিন্তু আর্দ্রতার কারণে এ গরম ঠেকেছে অসহ্য পর্যায়ে। সোমবার চট্টগ্রামে তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সবচেয়ে বেশি ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় পটুয়াখালীতে। আর ঢাকার তাপমাত্রা ৩৪ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমার লক্ষণ নেই। তবে হঠাৎ হালকা বা মাঝারি বৃষ্টিপাতে কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আতিকুর রহমান জানান, বাংলাদেশের গ্রীষ্ম ঋতুতে এ তাপমাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার অসহ্য গরম অনুভূত হওয়ার মূল কারণ ‘এল নিনো’। এর আগের বছরগুলোতে এ সময় মাঝে মাঝে বৃষ্টি এবং ঠা-া হাওয়া পরিবেশকে এতটা উত্তপ্ত হতে দেয়নি। কিন্তু এবার প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট এ অবস্থা সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। বছরটি ঠিক আগের বছরগুলোর মতো নয়। এর প্রভাবে বেশ উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করছে বাংলাদেশ, ভারত এবং বঙ্গোপসাগর সন্নিহিত দেশগুলোতে। গরম বেড়েছে, বৃষ্টিপাত কমেছে।
দেশে বিগত কয়েকদিনে অব্যাহত গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। একান্ত জরুরী কাজ না হলে মানুষ ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু কর্মজীবীদের বের না হয়ে উপায় নেই। পিচঢালা সড়ক ও ইট-পাথরের ভবনগুলোর বিকিরণ করা তাপে অবস্থা খুবই অসহনীয়। গরমের ছুটি শেষে স্কুল খুলেছে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের। কিন্তু সে বন্ধ শেষ হলেও গরম শেষ হয়নি। ঘরে ঘরে জ্বরে আক্রান্ত শিশু থেকে সকল বয়সী নারী-পুরুষ। আমাশয় ও ডায়রিয়ার প্রকোপও পরিলক্ষিত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি। ভিড় বেড়েছে ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারগুলোতেও।
চিকিৎসকদের পরামর্শ রয়েছেÑ এ গরমে যতটা সম্ভব ঠা-ার মধ্যে থাকা, নিয়মিত গোসল করা ও পেটের পীড়া দেখা দিলে বিশুদ্ধ নরমাল পানি ও খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা। এছাড়া ফলের এ ভরা মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খাওয়া যেতে পারে। তবে কোনভাবেই কলকারখানায় কৃত্রিম উপাদানে তৈরি কোমল পানীয় পান করা যাবে না।
প্রচ- গরমে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। মাঠে-ময়দানে যারা কাজ করছেন, পিঠপোড়া গরম তাদের ক্রমেই দুর্বল করে তুলছে। অতিরিক্ত ঘামে পানিশূন্যতায় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। নগরজীবনে রিক্সাচালক ও সাধারণ শ্রমিকদের দেখা যাচ্ছে সামান্য ছায়া ও ঠা-া পরিবেশের জন্য সুশীতল জায়গার সন্ধানে। নগরীর বিভিন্ন পার্কের বেঞ্চে শুয়ে, ঘুমিয়ে ও গাছতলায় বসে কিছুটা সময় তারা অতিবাহিত করছেন ফের কাজের জন্য শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টায়। চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই একই চিত্র বলে জানা যায় আবহাওয়া দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে। তবে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। এ মুহূর্তে মাঝেমধ্যে হালকা কিংবা মাঝারি ধরনের বর্ষণ হলেও তাতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস নেই।
এদিকে, তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। এসি, রেফ্রিজারেটর, বৈদ্যুতিক পাখাসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চাপ পড়েছে বিদ্যুত ব্যবস্থার ওপর। ফলে নিয়মিত বিরতিতে চলছে লোডশেডিং। এ বিদ্যুতহীনতা মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়েছে। বিদ্যুতসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোও যেন এখন রয়েছে স্বস্তির বৃষ্টির প্রত্যাশায়।
শীর্ষ সংবাদ: