ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল এহসান

সত্যপ্রিয় মানুষটি

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৭ মে ২০১৬

সত্যপ্রিয় মানুষটি

পুত্র মুনতাসীর মামুনকে নিয়ে লেখক-গবেষক পিতা এক লেখায় জানিয়েছেন- মামুন যখন তার গর্ভধারিণী জননী জাহানারা বেগমের গর্ভে, মা তখন স্বপ্নে দেখেছিলেন এক পুণ্যময় জ্বলন্ত সূর্য। যে সূর্যের রশ্মি চারদিকে আলোকিত করেছে, করেছে উদ্ভাসিত। মামুনের নানা ইরমানুল হক জানতে পেরে সেদিন বলেছিলেন- পুত্র সন্তান আসছে আর সে হবে প-িত। জননীর স্বপ্ন দেখা ফল নিয়ে আমরা বিতর্কে না গিয়ে প্রতীকের আশ্রয় নিতে পারি। সূর্য-জীবন, জ্ঞান, মুক্তি, বিপ্লব, বিদ্রোহ ইত্যাদির প্রতীক। মামুনের জীবনে ওইসব অনুষঙ্গ অনিবার্য হয়ে এসেছে তা আমরা দেখতে পাই। মুনতাসীর মামুন যৌবনে পা দেয়ার আগেই প্রস্ফুটিত হন। সৌরভ ছড়িয়ে জানিয়ে দেন শিশু সাহিত্যের মধ্য দিয়েই আসছেন একজন আলোকিত মানুষ। কৈশোরেই চট্টগ্রামের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে গল্প কবিতা তথা সৃষ্টিসম্ভার। ১৯৬২ সালে সপ্তম শ্রেণীতে থাকাবস্থায় ‘খেলাঘর’-এ ছাপা হয় গল্প ‘দুই বন্ধু’। ১৯৬৩ সালে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন সারা পাকিস্তানে। বাংলা ভাষায় লিখিত শিশুতোষ গল্প বিভাগে ছিনিয়ে নেন প্রেসিডেন্ট এ্যাওয়ার্ড। শ্রেষ্ঠ এ গল্পটির নাম ছিল ‘বালি মামুন ঢেউ’। শিশু সাহিত্যের হাত ধরে শুরু হলো সৃষ্টিশীলতার জগতে পথচলা। মনোভূমির পলিমাটি আমরা আজকের যে বৈচিত্র্যময় কর্মকা-ের মুনতাসীর মামুনকে আস্বাদন করি, যে বৃক্ষের ছায়া পাই তার মনোভূমির ভিত্তি সৃষ্টি হয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রসহ শৈশব-কৈশোরের অনুকূল পরিবেশ। পিতা মিসবাহউদ্দিন খান ছিলেন শিক্ষক, গবেষক ও লেখক। চাচা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। এই চাচার সংস্পর্শে এসে তার ক্রমবিকাশ ঘটে। শিশুকাল থেকেই চাচার সাহচর্য পান মুকুলিত হওয়ার আগেই। সংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল পরিবেশ ও জ্ঞান ভা-ারই মূলত মনোভূমি গড়ে উঠতে সহায়ক হয়। যৌবনে দাও রাজটিকা বাঙালীর মুক্তির মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৭১ সালে তরুণ মুনতাসীর মামুন ঘরে বসে থাকতে চাননি। মুক্তির দিশারীর সৈন্য হয়ে লাখ লাখ তরুণ যখন সশস্ত্র সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত মুনতাসীর মামুনের রক্তেও সেই ঢেউ লাগবে এটিই স্বাভাবিক। রক্তে যার মুক্তি-সংগ্রাম, অন্যায়-অত্যাচার আর কূপম-ূকতার বিরুদ্ধকণিকা-তিনি ঘরে বসে থাকেন কীভাবে? পাকিস্তানী হায়েনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করলে চাচা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বোঝালেন যুদ্ধ অনেকভাবে করা যায়। তাকে প্রভাবিত করলেন ভিন্নমাত্রার রণকৌশলে। যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়েই হয় না কলম দিয়েও হয়। অসির চেয়ে মসি কোন অংশে কম নয়, অন্তত ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে। যুক্ত হয়ে গেলেন চাচার সঙ্গে গোপন পত্রিকা ‘স্বাধীনতায়’। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। মুনতাসীর মামুনের সামাজিক রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার স্ফূরণ মূলত ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আদর্শগত চেতনার বহির্প্রকাশ ঘটে এ সময়। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন। সেই যে পথচলা শুরু তা এখনও অবিরাম। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর প্রথম নির্বাচনে (১৯৭২) তিনি নির্বাচিত সাহিত্য সম্পাদক। তার সম্পাদনায় ডাকসু থেকে প্রকাশিত হয় ‘ছাত্রবার্তা’। এটি ছিল পাক্ষিক। একই সময়ে তিনি সংস্কৃতি সংসদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন সুচারুভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র জীবনের মধ্য গগনে থাকতেই প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াসের মধ্যেই স্পষ্ট হয় তার সাংগঠনিক ক্ষমতা। বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এমন সাংগঠনিক ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগরের পরিচয় এ লেখার অন্য অংশে আমরা পাব। প্রথম যৌবনের অর্জনের মধ্যে উল্লেখ করার মতো আর একটি বিষয় হলোÑ স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনিই প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। বহুপ্রজ মুনতাসীর মামুন মুনতাসীর মামুনের পরিচয় স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা কঠিন। লেখালেখি শুরু করেছিলেন শিশু সাহিত্য দিয়ে। সেই ১৯৬৮ সালে সত্যেন সেন ও আহমদ ছফার প্রচেষ্টায় তার প্রথম শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘গল্প বলি’ প্রকাশিত হয়। গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকে ছোট গল্প ও ‘বিচিত্রা’য় সাংবাদিকতায় নিমগ্ন ছিলেন। যদিও ১৯৭৪ সালে নিজ বিশ্ববিদ্যালয় নিজের বিভাগে শিক্ষক হিসেবে মানুষ গড়ার দায়িত্ব নেন। পরবর্তী সময়ে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন গবেষণাকর্মে। শিশু সাহিত্য ও গল্প লেখা থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব গল্প লেখা হয়েছে, যে গল্পকারদের আমরা দেখতে পাই তাদের প্রতিভার কাছে আমি কিছু নই (এটা অবশ্য তার বিনয়)। তাছাড়া মনে হলো অন্তিমের বিচার হবে বাংলা ভাষায় রচিত লেখা নিয়েই। সে বাংলাদেশের হোক, পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আমেরিকার অধিবাসী হোক। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের বৃত্তে বন্দী থাকব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর প্রবন্ধ ও গবেষণাকর্মে নিবিষ্ট হয়ে পড়েন। ইতিহাসের জন্য বিচিত্র বিষয়ের দিগন্ত তার সামনে উন্মোচিত হতে লাগল। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের কথা ভাবতে গিয়ে একে একে নানা বিষয় তার কাছে ধরা দেয়। তিনিই প্রথম অনুভব করেন পূর্ববঙ্গ অনেক আগে থেকেই ইতিহাসও গবেষণার বিষয়ে অবহেলিত। যা কিছু কাজ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাকেন্দ্রিক। পূর্ববঙ্গের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা মামুনের জন্য তা আত্মপীড়ার বিষয়। দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতা থেকে উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গকে নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণাকর্মে নেমে পড়েন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ১৯১১, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, ভাষা হরণের চেষ্টা ইত্যাকার অত্যাচার থেকে গড়ে উঠেছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ। মামুনের চেতনায় মজ্জাগত ‘সাম্যবাদ’-এর দর্শনই মূলত উদ্বুদ্ধ করে এ কর্মে। যে কারণে পূর্ববঙ্গের উনিশ শতকের সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে গবেষণাকর্ম তাকে এক অনন্য স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। উনশ শতকের পূর্ববঙ্গ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের উপহার দিলেন ‘উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের মুদ্রিত পুঁথি, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের থিয়েটার, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সভাসমিতি, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের থিয়েটার ও নাটক, উনিশ শতকে বাংলাদেশের থিয়েটার, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের প্রতিক্রিয়া’ ইত্যাদি। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা আলোচিত হয়েছে ‘উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র’। যা তার দীর্ঘ ৩৫ বছরের একাগ্র কর্মপ্রচেষ্টার ফল। ১৪ খ-ে প্রকাশিত এ মূল্যবান গ্রন্থ ইতিহাসের আকর। এই গবেষণা গ্রন্থের জন্য তিনি ভারতের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত একমাত্র তিনিই এ পুরস্কার লাভের অধিকারী। বিদ্ব্যজনের অভিমত, পূর্ববঙ্গ নিয়ে তার এ কর্মই বাঁচিয়ে রাখবে যতদিন বাংলা ভাষা ও বাঙালী থাকবে। ঔপনিবেশিক আমল, পাকিস্তানের এক চক্ষু দানব শাসনের সময় থেকেও বাংলা ও বাঙালী নির্যাতিত, নিপীড়িত। নানা নিবর্তনমূলক প্রেক্ষাপটে বাঙালীও রুখে দাঁড়িয়েছে। উৎসর্গ করেছে জীবন। ‘মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে’ আত্মবলিদানের ঐশ্বর্যের খাতায় ’৫২, ’৬৬, ’৬৮, ’৬৯ পরিশেষে এসেছে ’৭১ রক্তের ধারায়। ’৭১-এর স্বাধীনতা জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হলে বাঙালী বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে ঠাঁই নেয়। যা আমাদের গর্ব, অহঙ্কার। স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত প্রথম দশকেই মুক্তিযুদ্ধের অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে থাকে। বিকৃত হতে থাকে ইতিহাস। ব্যক্তি পর্যায়ে মুনতাসীর মামুনই খুব সম্ভবত প্রথম এগিয়ে আসেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অন্বেষণ ও আহরণে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা, অনালোকিত-অনালোচিত বিষয় তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৫০টি গ্রন্থে। তার এই প্রচেষ্টা তাকে এক অসাধারণ উচ্চতায় আসীন করেছে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি, মক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মহল, গবেষক তথা আগামী প্রজন্ম এ কারণে মুনতাসীর মামুনের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। দেশ-জাতিকেও এ কর্মের মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞপাশে আবদ্ধ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাকে কেন্দ্র করে বিস্তর ইতিহাস লেখা হলেও পূর্ববঙ্গের প্রাণ ঢাকা নিয়ে অনেকটাই ‘দুর্ভিক্ষ’। মুনতাসীর মামুনের পারিবারিক শিকড় বৃহত্তর কুমিল্লায় হলেও তার জন্ম পুরান ঢাকায়। বেড়ে ওঠার একটা সময় ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধুু এ কারণেই নয় একজন ইতিহাসবিদ হয়ে, ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে দেখলেন ঢাকার ঐতিহ্য কমা নয়। ঢাকার অনেক কিছুই চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখলেন। সেই বেদনা থেকে জাগ্রত হলো দায়বদ্ধতা। আগ্রহী হয়ে উঠলেন ঢাকা বিষয়ে। যদিও সাংবাদিকতার জীবনে ‘বিচিত্রা’য় এর আগে ঢাকার হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু ও বুড়িগঙ্গার বেহাল নিয়ে লিখেছেন। তিনি ‘ঢাকা : স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ (সিরিজ), ঢাকার সেই সব বিখ্যাত মানুষ, দেয়ালের শহর ঢাকা, উনিশ শতকে ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া বইয়ের খোঁজে, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান, কর্নেল ডেভিডসন যখন ঢাকায়, ঢাকা : ক্লে’র ডায়েরি (১৮৬৬-১৮৬৭), ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদান, ঢাকার খাল পোল ও নদীর চিত্রকর’সহ ঢাকা বিষয়ে প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ প্রণয়ন করে কৃতার্থ করলেন ঢাকাবাসী তথা দেশকে। তার এই শ্রম ও কর্মনিষ্ঠার ফল যুগ যুগ ধরে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুনতাসীর মামুনের ঢাকা নিয়ে কর্মযজ্ঞ ও তার সামগ্রিক কাজের মূল্যায়ন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান করেন এভাবেÑ ...‘আমি তার লেখার একজন অনুরক্ত ভক্ত পাঠক। তিনি একজন ইতিহাসবিদই শুধু নন, সুলেখকও। তার লেখা একবার শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি কিংবা শান্তি পাওয়া যায় না। ঢাকা সম্পর্কে লেখা তার বইটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। আমার জন্মশহর বিষয়ে এ রকম তথ্যসমৃদ্ধ বড় আকারের বই আমার চোখে পড়েনি। লেখাও চমৎকার। মুনতাসীর মামুন ইতিহাসে ডক্টরেট ডিগ্রি হাসিল করেছেন আগেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা অধ্যাপক। কিন্তু প্রগতিশীল এবং সুশীল সমাজের অন্যতম প্রবক্তা এই সৎ মানুষটি তার অনুসন্ধিৎসা, বিবেচনা এবং কর্ম শুধু ইতিহাসচর্চায় সীমিত রাখেননি। তিনি আমাদের এই অসহায়, নানাদিক থেকে উৎপীড়িত ডোবাসদৃশ সমাজ নিয়ে সব সময় চিন্তা করেন। কি করে এই সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদগ্রস্ত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের পথ দেখানো যায় তিনি আরও কিছু আলোকিত অগ্রসর ব্যক্তির মতোই সচেষ্ট রয়েছেন।’... খাপ খোলা তলোয়ার মুনতাসীর মামুন মূলত ইতিহাসবিদ, গবেষক। তার ধ্যান-জ্ঞান ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই। তিনি এতটাই এ বিষয়ে সচেতন যে, সব সময় মনে রাখেন সেই অমোঘ সত্যটি ‘আজ যা ঘটে গেল আগামীকাল তা ইতিহাস।’ যে জন্য তিনি সব সময় তার লেখায় সময় ও বর্তমানকে বেশি ধরতে চান। কেননা আজ ও বর্তমান কালের গর্ভে বিলীন হয়ে আগামীতে ইতিহাসের উপাদান হয়ে দাঁড়াবে। তার ইতিহাস বিষয়ের মধ্যে দেখতে পাই ঐতিহ্য, স্বদেশপ্রীতি, সুশীল সমাজ, জনসচেতনতা, জাতীয়তাবাদী চেতনা সর্বোপরি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের প্রতি ইঙ্গিত। সময়কে ধরতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সমসাময়িক বিষয়ের বিশ্লেষক, দিকনির্দেশক। সত্য, ন্যায়-নীতি, আদর্শকে আঁকড়ে ধরে তার কলম সব সময় ঝলসে ওঠে অন্যায়-অবিচার, অমানবিকতা, কুসংস্কার, কূপম-ূকতা, ধর্ম ব্যবসা, মৌলবাদ তথা জঙ্গী-স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে। তার অকাট্য যুক্তি, ক্ষুরধার লেখনী পাঠককে আন্দোলিত করে। এ জন্য তিনি অনেক গুণের সঙ্গে হয়ে উঠেছেন সমসাময়িক ঘটনাবলী ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তার রাজনৈতিক ভাষ্য, কলাম, মন্তব্য প্রতিবেদন সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কাছে যেমন কাক্সিক্ষত তেমনি পাঠকরাও থাকেন অধীর আগ্রহে। সমসাময়িককালে দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার ভাষ্য, কলাম-নিবন্ধের ধারে-কাছে তেমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। তাৎক্ষণিক লেখায় তার জুড়ি মেলা ভার। দ্রুত মন্তব্য, বিশ্লেষণ দিয়ে তিনি ক্ষান্ত হন না, প্রাসঙ্গিক তথ্যও তিনি জুড়ে দেন; যা লেখা ও পাঠককে সমৃদ্ধ করে। তার শব্দচয়ন প্রায় ঠোঁটের ভাষা হওয়ায় সব শ্রেণীর পাঠকের বোধগম্য হয়, পশে যায় দ্রুত অন্তরে। সহজ-সরল শব্দ ও বাক্য বিন্যাসে সিরিয়াস ও জটিল বিষয় হয় সহজ। তবে তাতে থাকে এত ধার যেন তার কলম খাপ খোলা তলোয়ার। সত্য বলতে কারও ক্ষেত্রে তিনি দ্বিধা করেন না। মৌলবাদ, জঙ্গী, ধর্ম ব্যবসায়ী, কুসংস্কার ও স্বাধীনতাবিরোধী তথা তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে যেমন উচ্চকণ্ঠ তেমনি স্বাধীনতার পক্ষশক্তি, প্রগতিশীলদের নানা অসঙ্গতি, ত্রুটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না। এটাই মুনতাসীর মামুনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। যে জন্য সবার কাছে তিনি সত্যপ্রিয় মানুষ। এভাবেই তিনি উপহার দিয়েছেন ৩০৯টি গ্রন্থ। শহীদ মিনার থেকে মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল রক্ত মূল্য আর সম্ভ্রমসহ সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও কিছু কুলাঙ্গার ওই যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে সব রকম অপরাধে সহায়তা করে। তারা বাঙালী হলেও মনেপ্রাণে পাকিস্তানী তখনও এবং এখনও। গণহত্যা, ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবী বিনাশকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা শান্তি কমিটির বিচারের দাবি ওঠে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরের বছরই ১৯৭২ সালে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিচারের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। ওই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ’৭২ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে দাবি তুলেছিলেন শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-আত্মীয়স্বজন। শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হানের ভাই শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে মুনতাসীর মামুনও ছিলেন দাবি আদায়ের কাতারে। তারপর অনেক ইতিহস। পঁচাত্তরের পরে দেশ চলতে থাকল পাকিস্তানী রাজনীতির আদলে। সেখানেও মুনতাসীর মামুনের প্রতিবাদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ’৭২-এর মূল সংবিধান মোতাবেক চারটি মৌলনীতি পরিবর্তন না করে রাষ্ট্র পরিচালনার দাবিতে সোচ্চার যারা সোচ্চার হলেন তাদের অন্যতম মুনতাসীর মামুন। বার বার ক্ষত ও রক্তাক্ত করা হলো পবিত্র সংবিধান। শক্তি হয়ে উঠল পরাজিত শক্তি, ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদীরা। আর তা সরকার ও রাষ্ট্রীয় পোষকতায়, বদান্যতায়। এর মধ্যেও চলল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংগ্রাম। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সারা বাংলা জেগে উঠল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ছায়াতলে তখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি। শাহরিয়ার কবির কেন্দ্রে থেকে চালিয়ে নিচ্ছেন। এক সময় জাহানারা ইমাম পরলোকে পাড়ি জমান। তখনও কেন্দ্রে শাহরিয়ার কবীর। মুনতাসীর মামুনও আছেন সমানে রাজপথ এবং কলম হাতে সংবাদপত্র সাময়িকীতে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে অবর্ণনীয় নির্যাতন নেমে আসে দুই বন্ধু অর্থাৎ মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবিরের ওপর। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ওপর লেলিয়ে দেয়া হয় ছাত্রদল-ছাত্রশিবির ও তৎকালীন সরকারের পেটোয়া বাহিনী পুলিশ। হামলা, মিথ্যা মামলা, বিনাবিচারে আটকের মাধ্যমে এক নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তবুও থেমে থাকেনি ঘাদানিকের সৈন্যরা। তার আগে গণআদালতে দেশের বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনরা যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ পরিমাপ করে কেমন শাস্তি হতে পারে তার একটা ‘রায়Ñ সুপারিশ’ প্রকাশ করে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সেদিন বিশ্ব ‘অবাক তাকিয়ে’ ছিল বাংলাদেশের দিকে। আন্দোলনের গতি আসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। গঠিত হয় একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল। এ পর্যায়ে সরকারকে আনতে ও আসতে যারা সহায়তা করেছিলেন তাদের মধ্যে মুনতাসীর মামুনের লেখনী অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল তা অনস্বীকার্য। তার রাজপথের ভূমিকাও কোন অংশে কম নয়। তার রাজাকারের মন, সেই সব পাকিস্তানী, মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র জনমত গঠনে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল। এ পর্যন্ত শেষ হলে না হয় কথা শেষ হয়ে যেত। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই সাহসী, দেশপ্রেমিক মানুষটি রাজাকার শিরোমণি, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের মীর জাফর বলে খ্যাত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে নজির সৃষ্ট করেছেন। বিপন্ন জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে তখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি তথা প্রগতিশীল এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ‘কিয়ামত’ নেমে এসেছিল-তা এখন ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। মুক্তবুদ্ধি বা মুক্তচিন্তার চর্চাকারীদের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় খড়গ্। রাষ্ট্রীয় পোষকতায় ধর্মের অপব্যাখ্যা ও ভুল ব্যাখ্যার কষাঘাত গিয়ে পড়ে জাতির বিবেক বলে পরিচিত মনীষীদের ওপর। অহরহ তারা নাস্তিক, মুরতাদ, বেধর্মী ইত্যাকার বিশেষণে জর্জরিত হতে থাকেন। মুনতাসীর মামুন যেহেতু এদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন সব মিলিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের মিত্ররা তাকে ৪ বার সরাসরি হত্যার চেষ্টা চালায় এবং ৩ বার মুরতাদ ঘোষণা করে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের কাছে একজন অধ্যাপক, গবেষক, লেখক, ইতিহাসবিদ কি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ২০০১ সালে? ওই বছর ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যায় স্ত্রী-সন্তানদের সামনে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে মিথ্যা ও হাস্যকর এক মামলা (ময়মনসিংহে বোমা হামলা) দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে। রিমান্ডে নিয়ে অসম্মান করা হয়; রাখা হয় সন্ত্রাসী ব্যাঙা বাবুর সঙ্গে। মুনতাসীর মামুন যে সাধারণ মানুষের মনে কতটা স্থান করে নিয়েছিলেন তা বোঝা যায় তার মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদী মানুষ জেগে ওঠায়। সরকার যে ন্যক্কারজনক কাজ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এ ঘটনায় বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীনের প্রতিবাদে। এখানে স্পষ্ট হয় সরকার ঘোষিত ‘অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি ও নাশকতা চালানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ এবং রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণায় জড়িত’ ষড়যন্ত্রের হোতা মুনতাসীর মামুন নন সরকারই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। হাইকোর্টে রিট করে অনেক নাটকীয়তার পর তিনি মুক্তি পান। একই দশা ঘটে বন্ধু-সহচর শাহরিয়ার কবিরের বেলায়। মুক্তি পেয়ে দমে থাকেননি তিনি। আবার শক্ত হাতে কলম ধরেন ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে। সেই সব পাকিস্তানীর স্বরূপ সন্ধানে পাঠক ও বোদ্ধা মহলে মুনতাসীর মামুনকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলে দেয় যে বিষয়টি তা হলোÑ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব পাকিস্তানী সেনানায়ক গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধন, ধর্ষণ ও সম্পদ বিনষ্টে নেতৃত্ব দিয়েছিল আবার কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুশীল, সভ্য মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে জেল-জুলুম সহ্য করেছিলেন তাদের খুঁজে সাক্ষাতকার গ্রহণ ও মতামত গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে ধরা। বৈরী পরিবেশে পাকিস্তানে গিয়ে কেন একাত্তরে তারা এমনটি করেছিল, তাদের মনোভঙ্গি উদ্ধার করেন। কেন এ দেশে রাজাকার, আলবদর, আলশামস সৃষ্টি করেছিল তার যথাযথ কারণ উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। তাকে এ কাজে সর্বতোভাবে সহায়তা করেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর মহিউদ্দিন আহমদ। আর অর্থ ও পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসেন বিচারপতি রেহমান সোবহান। সুবিধা হয় মহিউদ্দিন সাহেব এক সময় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আমেনা সাঈদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, তার সহায়তা নেয়া হয়। বেনজীর ভুট্টো, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমদ লেঘারি, পরাজিত সেনাপ্রধান এএকে নিয়াজী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সাকারী পরিচিত রাও ফরমান আলী প্রমুখের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। ১৯৯৮ সালের এ কর্মযজ্ঞ তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে আসে। যদিও এ কাজে সে সময় ‘পাকিস্তানী দালাল’ তকমা গায়ে লাগার ভয় ছিল। প্রতিষ্ঠান-সংগঠন পটীয়সী মুনতাসীর মামুনকে প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পরশ পাথর মনে করেন অনেকে। তিনি যে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে হাত দেন তা যেন সোনা হয়ে যায় অর্থাৎ দাঁড়িয়ে যায়। এসব প্রতিষ্ঠান,সংগঠন সবই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আধার বা সংশ্লিষ্ট। উল্লেখযোগ্য কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে; যেগুলোয় তিনি উদ্যোক্তা, থিংক ট্যাংক, শীর্ষ ব্যক্তি ও ধারণা প্রণেতা। যেমনÑ গত শতাব্দীর সাতের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেই গড়ে তোলেন ‘ইতিহাসচর্চা কেন্দ্র’। ১৯৯৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট।’ জড়িত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা নগর জাদুঘর ও বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠায়। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ (আইসিবিএস)। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালনের কথা সুবিদিত। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে স্মৃতিস্তম্ভ ও সারাদেশের বধ্যভূমিতে স্তম্ভ নির্মাণের কমিটির তিনি সদস্য। বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর তিনি কর্ণধার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে তিনি প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৮ সালে সরকার গ্রন্থাগার ও গ্রন্থনীতি সংস্কারে যে কমিটি গঠন করে তিনি ছিলেন এর সভাপতি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার স্থাপনের রূপকারদের তিনি অন্যতম। শিল্পকলা আইনের অন্যতম প্রণেতা মুনতাসীর মামুন। মানুষ মানুষের জন্য মুনতাসীর মামুনের অনেক গুণ ও যোগ্যতার খবর আমরা পেলাম। ব্যক্তি মামুন কেমনÑ সে তৃষ্ণা পাঠকের থেকেই যায়। ব্যক্তি মুনতাসীর মামুন যে কত উদার, দরদী আর মানবিক তার স্বাক্ষর রেখেছেন ‘মুনতাসীর মামুনÑ ফাতেমা ফাউন্ডেশন’-এ। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। দেশের অনেক গরিব মেধাবী শিক্ষার্থী এই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় শিক্ষালাভ করছেন। এ ছাড়া একাত্তরের বীরাঙ্গনা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা এই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পেয়ে থাকেন। অমূল্য রতœভা-ার মুনতাসীর মামুন উঁচুদরের একজন সংগ্রাহক। তার সংগ্রহে দুর্লভ হাজারখানেক শুধু আত্মজীবনীসহ হাজার হাজার পুরনো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ রয়েছে। রয়েছে নন্দলাল বসু, জয়নুল আবেদীন, পরিতোষ সেন, রামকিংকর বেজ থেকে শুরু করে কামরুল হাসান-মুর্তজা বশীর, রফিকুন নবী, কাইউম চৌধুরী, হাশেম খান ও হালের তরুণ রোকেয়া সুলতানাসহ অনেক শিল্পীর শিল্পকর্ম। রয়েছে বিভিন্ন আমলের দুর্লভ মুদ্রা ও ডাকটিকিট। মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা বিষয়ক বইও আছে। ১০ হাজারের অধিক বই তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় রয়েছে। এর পাশাপাশি পুতুল, মুখোশ, সিরামিকের সংগ্রহও ইর্ষনীয়। আলাপকালে তার এই মূল্যবান সংগ্রহ ভবিষ্যতে কী করবেন জানতে চাইলে বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল ‘মুনতাসীর মামুন সংগ্রহশালা’ করব। কিন্তু আর্থিক কারণে বিশেষত জায়গার অভাবে তা হচ্ছে না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকা হলে আবেদন করলে এর একটা বিহিত হতো। কিন্তু আমাদের দেশে শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক পাওয়া ভার। যদি শেষ পর্যন্ত কারও সহায়তা না পাই তবে তা হারিয়ে যাবে, ছিন্নভিন্ন হবে। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও অশ্রু ঝরানো কথামালা গত শতাব্দীর আটের দশকের মাঝামাঝি (খুব সম্ভব ১৯৮৫ সাল) ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণার অনুষ্ঠানটির কথা অনেকেই হয়ত ভুলতে বসেছেন। সেদিন যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের তা মনে দাগ কেটে আছে। মঞ্চে কবি সুফিয়া কামাল, তার দুই পাশে বঙ্গবন্ধুর দুই আদরের দুলারী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। বাড়িটিকে ঘিরে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। যে বাড়িটি বাঙালীর হৃদয়, বাঙালীর ঠিকানা সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেকেই আবেগাকুল হবেন সেটাই স্বাভাবিক। অনুষ্ঠানের আলোচক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন যখন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত হাজির করে বক্তৃতা করছেন মাঝপথেই এতটা আবেগঘন হয়ে গেলেন উপস্থিত সবাইÑ অশ্রু আর ধরে রাখতে পারলেন না কেউ। মঞ্চে উপবিষ্ট শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা ও কবি সুফিয়া কামাল ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সেদিনের ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন পরদিন ঢাকার প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এমনই আবেগ সৃষ্টি করতে পারেন মুনতাসীর মামুন তার বক্তৃতায়। শত্রু কখনও মিত্র হবে না মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রশ্ন করা হয়Ñ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও পাকিস্তান কেন শত্রুতা করছে? এর জবাবে তিনি বলেন, আমি আগেও বলার চেষ্টা করেছি এখনও বলছি পাকিস্তান একটি প্রত্যয়, প্রতিশোধপরায়ণ দেশ। ’৭১-এর পরাজয়ের জ্বালা ভুলতে পারেনি। তারা যে কোনভাবে প্রতিশোধ নেবেই। তাদের দোসররা এ দেশে এখনও রাজনীতি করছে। তাদের মাধ্যমে নানাভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। জঙ্গী ও মৌলবাদ তারা তোষণ করে। তাদের অস্থিমজ্জায় এটা মিশে আছে। ১৯৯৮ সালে এক পাকিস্তানী ওই দেশেই আমাকে চুপিচুপি বলেছিলÑতোমরা পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত হয়ে ভাল করেছ, উন্নতি করেছ; পাকিস্তানের আর উন্নতি হবে না। বাংলাদেশের উন্নতি বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা না থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- কার্যকর হতো না। এসেব ঈর্ষান্বিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তান এখনও শত্রুতা করছে। আমাদের প্রধান শত্রু পাকিস্তান। এদেশে যদি কখনও বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় আসে তবুও পাকিস্তান বাংলাদেশের শত্রু হিসেবেই থাকবে, চরিত্র বদলাবে না। অবসর বলে কিছু নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে দীর্ঘ শিক্ষকতা শেষে চলতি বছরের মাঝামাঝি অবসরে যাচ্ছেন মুনতাসীর মামুন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল অবসরে গিয়ে কী করবেন বা অবসর সময় কীভাবে কাটাবেন? উত্তরে বলেন, একজন শিক্ষক, গবেষক বা সৃষ্টিশীল মানুষের অবসর বলে কিছু নেই। এই যে ড. আনিসুজ্জামান স্যার, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার এরা কি সেই অর্থে অবসরে গিয়েছেন? আমি অনেক আগে থেকেই শিক্ষকতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা রুটিনমাফিক কাজ, আড্ডা দেয়া এসব থেকে নিজেকে বিযুক্ত রেখেছি। অনেক কাজ সামনে পড়ে আছে। আমার সময় ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার নির্ঘণ্ট প্রকল্প। ত্রিশটি গ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। সারাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে তার গতানুগতিক তালিকা বা প্রতিবেদন তৈরির কাজ এটা নয়। গণহত্যার প্রেক্ষাপট, কারা শহীদ, কারা ঘাতক, ক্রস চেকিং, অন্তত দশটি সাক্ষাতকার এমনভাবে উপস্থাপন যেন কেউ আইনী ফাঁকফোকর না পায়, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারে। অনেকেই বক্তৃতায় বড় বড় কথা বলেন। কাজের বেলায় টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না পৃষ্ঠপোষকতা। অর্থের অভাবে পিছিয়ে যাচ্ছি। আশার কথা প্রধানমন্ত্রী খুলনায় ‘১৯৭১ : গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’Ñএর জন্য জায়গা দান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক অবসরের পরে আমি আরেকটি কাজ সম্পন্ন করার স্বপ্ন দেখি তা হলোÑ উনিশ শতকের ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে গবেষণকর্ম শেষ করে যেতে যাই। অনেক দূর এগিয়েছি। অনেকে বলছেন কাজটি আমি না করে গেলে হয়ত শেষ হবে না। এটি শেষ করতে পারলে হবে চমৎকার একটি কাজ। শেষ হইয়াও হইল না শেষ এ লেখাটি শুরু হয়েছিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর একটি বিরল সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। শেষ করতেও তার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। মুনতাসীর মামুনকে তিনি কীভাবে দেখেন তা আমাদের জানা দরকার। তিনি লিখেছেনÑ...‘মুনতাসীর মামুনের নানা গুণ আমাকে আকর্ষণ করে। আমাদের মুক্তি সংগ্রাম এবং স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে চার মৌলনীতি : গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি তার আনুগত্য দৃঢ় ও নিখাঁদ। তার চোখে মানুষের নিকৃষ্টতম দোষগুলো হলো ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য যাবতীয় ভ-ামির আশ্রয় গ্রহণ এবং স্বৈরশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা। এসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মামুন সব সময় দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন।’... মুনতাসীর মামুন ৬৫-তে পা দিলেন গত ২৪ মে। আড়ম্বরপূর্ণ জন্মদিনও পালিত হলো। জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা। জয়তু মামুন! পঁয়ষট্টিতে নট আউট!
×