ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্বৃত্তরা দুর্গম এলাকায় গিয়ে আগুন দিচ্ছে সুন্দরবনে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

দুর্বৃত্তরা দুর্গম এলাকায় গিয়ে আগুন দিচ্ছে সুন্দরবনে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ সুন্দরবনের ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলা এলাকায় লাগা আগুন গত ৪৮ ঘণ্টায়ও নেভেনি। গত বুধবার বিকেলে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের তুলাতলা এলাকায় এ আগুন লাগে। শুক্রবার বিকেলেও বনের কমপক্ষে তিন কিমি এলাকার ১০টি স্থানে আগুন জ্বলতে ও ধোঁয়ার কু-লী উঠতে দেখা গেছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ায় দাবানলের আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। গেল ১৪ বছরে সুন্দরবনে লাগা ২৫টি অগ্নিকা-ের মধ্যে এবারের অগ্নিকা-ের ধরন একেবারেই ভিন্ন বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। বন কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোপূর্বে বনের একটি বা দুটি এলাকায় আগুন লাগলেও এবার দুর্বৃত্তরা সুপরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের অন্তত ১০ থেকে ১৫টি স্থানে আগুন দিয়েছে। এবার বনের একাধিক দুর্গম স্থানে একই সঙ্গে পরিকল্পিত নাশকতায় আগুন দেয়ায় তা নেভানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। প্রচ- তাপপ্রবাহ এবং ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পানির সহজ উৎস্য না থাকায় আগুন নেভানো যাচ্ছে না। বাতাসের কারণেও তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছে। তবে স্থানীয় জনসাধারণ ও বন বিভাগের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের খুলনা-বাগেরহাট-মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলার ৪টি ইউনিটের ৩২ কর্মী আগুন নেভাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয়ার কারণে ফায়ার লাইন কেটে তা নিয়ন্ত্রণ করতেও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ বেলায়েত হোসেন বলেন, দুর্বৃত্তরা এবার পরিকল্পিতভাবে বনের তুলাতলা এলাকার কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে আগুন দিয়েছে। বেশ দূরের এক একটি স্থানে আগুন দেয়ায় তা সম্পূর্ণ নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিছু এলাকায় এখনও সামান্য আগুন এবং ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। আমরা আগুন সম্পূর্ণ নেভাতে কাজ করছি। বনসংলগ্ন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই এলাকার আগুন এখনও অনিয়ন্ত্রিতভাবেই জ্বলছে। আগুন লাগার ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও তা নিভাতে পারেনি বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। বনজীবী সগির আকন, ফুল মিয়া কাজী, বাদল ফকির, বজলু হাওলাদার জানান, কমপক্ষে ৪ কিমি এলাকার দশটি স্থানে আগুন জ্বলছে। কাছাকাছি পানি না থাকায় এবং বাতাস ও তীব্র দাবদাহের কারণে তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্টের হচ্ছে। বৈরী এ পরিস্থিতিতে দাবানলের সৃষ্টি হতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মোঃ মানিকুজ্জামান বলেন, আগুন নেভাতে বুধবার সন্ধ্যা থেকে খুলনা, বাগেরহাট, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট কাজ করছে। ‘তীব্র গরম এবং পানির উৎস্য দূরে হওয়ায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে।’ সুন্দরবনে এবারের অগ্নিকা-ের এলাকাটি বেশ দুর্গম উল্লেখ করে তিনি জানান, ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলা এলাকায় আগুন নেভাতে তাদের প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের আড়ুয়ারবাড় খাল থেকে পানি আনতে হচ্ছে। প্রচ- গরমে এক নাগাড়ে কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, ‘এবারের আগুনের বিস্তৃতি অনেক বেশি। বাতাসের কারণে এরই মধ্যে আগুন ওই এলাকার উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়েছে। ফলে আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঘটনাস্থলটি বেশ দুর্গম হওয়ায় সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত দমকল কর্মীদের পক্ষে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।’ বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা’- সিও র‌্যাব-৬ ॥ এদিকে সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর শুক্রবার র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৬ খুলনার কমান্ডিং অফিসার (সিও) খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, ব্যক্তিস্বার্থে কিছু দুর্বৃত্ত ওই আগুন ধরিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মামলা করায় ক্ষুব্ধ তারা ‘প্রতিশোধ’ নিতে আবারও আগুন দেয়। সম্প্রতি ধানসাগর স্টেশনে বন রক্ষায় ওয়াচ টাওয়ার স্থাপনের কারণে সর্বশেষ (২৭-এপ্রিল) ওই দুর্বৃত্তরা উল্টো পথে নৌকায় করে বনের ভেতর দিয়ে এসে আধা কিলোমিটার পর পর ৬-৭টি স্থানে আাগুন দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ অপরাধীদের দমনে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। দুই রেঞ্জেই পাস পারমিট বন্ধ ॥ শুক্রবার বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোঃ জহির উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর জানান, কিছু এলাকায় এখনও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কত এলাকাজুড়ে আগুন ছড়িয়েছে বা কি ধরনের গাছপালা পুড়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি তিনি। তবে আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেলেও ফায়ার সার্ভিসকে সুন্দরবন থেকে সরিয়ে নেয়া হবে না। বন বিভাগের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও ওই এলাকায় পর্যবেক্ষণে থাকবে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আরও জানান, দফায় দফায় সুন্দরবনে আগুন লাগার কারণে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের দুটি রেঞ্জে শরণখোলা এবং চাঁদপাইয়ে সব ধরনের পাস পারমিট সাময়িকভাবে বন্ধ করে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তবে বাইরে থেকে আসা পর্যটকরা সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। সুন্দরবনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত জেলে বাওয়ালী, মৌয়াল ও সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে পাস পারমিট নিয়ে যারা সুন্দরবনে অবস্থান করছে, তাদের দ্রুত সুন্দরবন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৭ মার্চ, ১৩ ও ১৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় আগুন লাগে। সে সময় বন বিভাগের পক্ষ থেকে তদন্ত করে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দায়ী করা হয়। ওই ঘটনায় দুটি মামলাও করে বন বিভাগ। তবে এখনও কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি।
×