ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম, শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সরকারের রাজস্ব ক্ষতির প্রমাণ পেয়েছে রাজস্ব হিসাব নিরীক্ষা অধিদফতর। সরকারের বার্ষিক অডিটে ধরা পড়েছে ১০৪ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি, অনিয়ম ও হিসাবের গরমিল। অডিট রিপোর্টে আপত্তি তোলা হয়েছে অন্তত ৪১টি আর্থিক খাতে। যেখানে এসেছে উপাচার্যসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের ক্যাম্পাসের বাইরে বাড়ি ভাড়া, অতিরিক্ত গাড়ির জ্বালানি খরচ, ক্যাম্পাসবহির্ভূত স্থানে গবেষণা কেন্দ্রের ব্যয়, ভূমি রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত আর্থিক ক্ষতি, আইন লঙ্ঘন করে গাড়ি ক্রয়ে অনিয়ম, জমির অনিয়মিত নামজারিতে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘোরতর আপত্তি তোলা হয়েছে। রাজস্ব ক্ষতিসহ অর্থ ব্যয়ে ৪১টি অভিযোগের প্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের জবাব দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের এ অডিট রিপোর্টে। অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত ব্যয় করা অর্থ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ফেরত আনার সুপারিশ করা হয়েছে। রিপোর্টে প্রথমেই উচ্চ আদালতের রায় মেনে অনিয়মিতভাবে নিয়োগ করা এক হাজার ১৮৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত না করে কেবল ৯৮৮ জনকে চকরিচ্যুত করা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। অবশিষ্ট ২০১ জনকে বহাল রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত কোটি ৯২ লাখ আট হাজার টাকা ব্যয়ে আপত্তি তুলে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জবাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং-৫১২৫/২০০৪ তাং-২০/২/২০১২ এর রায়ের নির্দেশনা ১ মোতাবেক ৫টি পত্রিকার বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগকৃত সকলের চাকরি বাতিল করা হয়েছে। তাই ব্যয় হওয়া সমূদয় অর্থ সংশ্লিষ্টদের নিকট থেকে আদায় করতে হবে। একই সঙ্গে এ প্রশাসনে নিয়োজিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করায় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে প্রাপ্যতা না হওয়া সত্ত্বেও পদোন্নতি পদে যোগদানের তারিখ হতে সিলেকশন গ্রেড স্কেল প্রদান করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতির কথা বলা হয়েছে অডিট রিপোর্টে। রিপোর্টের ছয় নম্বর অনুচ্ছেদে অনিয়মিতভাবে নামজারি বাবদ অগ্রিম ২৪ লাখ টাকা প্রদান করা নিয়ে আপত্তি তুলে বলা হয়েছে, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া জবাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যেখানে মিউটেশন বাবদ মাত্র এক হাজার ১৭০ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা, সেখানে নামজারির জন্য ২৪ লাখ টাকা প্রদান অস্বাভাবিক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসবহির্ভূত মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের জমিসহ ক্রয়ে ৪২ কোটি ৪৭ লাখ তিন হাজার টাকা ব্যয় নিয়েও আপত্তি তুলেছে নিরীক্ষা অধিদফতর। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জবাবে বলেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধির ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে একটি অঙ্গীভূত ইনস্টিটিউট স্থাপন করবে। টুঙ্গিপাড়ায় যতদিন পর্যন্ত অবকাঠামোগত সুবিধাদি নিশ্চিত না হয় ততদিন পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম ঢাকায় পরিচালিত হইবে। সংবিধির উক্ত ধারা অনুযায়ী ইনস্টিটিউটটির কার্যক্রম ঢাকায় পরিচালিত হতে আইনগত কোন বাধা নেই। কাজেই ঢাকা শহরে ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকায় শিক্ষার্থী/অভিভাবক/শিক্ষক/গবেষকসহ সকলের জন্য অধিক সুবিধাজনক হয়েছে। অডিট অফিস বলছে, জবাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যেখানে টুঙ্গিপাড়ায় গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের কথা সেখানে যেহেতু অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত হয়নি সেহেতু গবেষণা প্রতিষ্ঠান গাজীপুরে হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্ডিকেট’ কৃত জবাবটিও সঠিক নয়। কারণ শিক্ষার্থী/অভিভাবক/শিক্ষক/ গবেষকসহ সকলের জন্য অধিক সুবিধা গাজীপুরেই। যে কোন প্রয়োজনে তাদের গাজীপুর ক্যাম্পাসেই যেতে হয়। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট তৈরির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে ঢাকার একটি ব্যয়বহুল আবাসিক এলাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিপুল অর্থের অপচয়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিরীক্ষাকে জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। নিয়োগ প্রজ্ঞাপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থানের শর্ত থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা তার আশপাশে উপাচার্যের বাসভবনের ব্যবস্থা না করে ঢাকার ধানম-িতে অফিস কাম বাসভবন ক্রয় বাবদ ব্যয় ৩৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় নিয়ে ঘোরতর আপত্তি তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন মোতাবেক গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে এবং দেশের যে কোন স্থানে আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধানম-িতে ভিসি মহোদয়ের সিটি অফিস কাম বাসভবন ক্রয় বাবদ অর্থ ব্যয় করে। অপরাপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসির অফিস এবং বাস ভবন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ৩০ কিলোমিটার দূরে ধানম-ি, ঢাকায় ভিসি মহোদয়ের বাসভবন কাম অফিস বিশ্ববিদ্যালয় স্বার্থের অনুকূলে নয়। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁওয়ে ইউজিসি ভবনসংলগ্ন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের এক লাখ বর্গফুট পার্কিংসহ স্পেস প্রাপ্তির অনুকূলে ইতোমধ্যে এক কোটি টাকা সাইনিং মানি পরিশোধ করা হয়েছে। উক্ত বিপুল পরিমাণ জায়গার সংস্থান হওয়া সত্ত্বেও উপাচার্যের অফিস কাম বাসভবন ক্রয়ে অনিয়মিত ব্যয় হিসেবে বিবেচ্য। উক্ত অর্থের সংস্থান করায় হয় ছাত্রছাত্রীদের নিকট হতে আদায় করা পরীক্ষা ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি ও অন্যান্য ফি থেকে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, উপাচার্যের অফিস কাম বাসভবন গাজীপুরেই থাকতে হবে এরও কোন আইনী বাধ্যবাধকতা নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয় আইনেও এ বিষয়ের কোন উল্লেখ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জায়গার স্বল্পতার কারণে উপাচার্যের বাসভবনসহ, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কোয়ার্টার নির্মাণ করা সম্ভবপর হয়নি। অডিট অফিস বলেছে, জনাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ উপাচার্য অফিস কাম বাসভবন গাজীপুরেই থাকতে হবে এরও কোন আইনী বাধ্যবাধকতা নেই এ কথা সত্য নয়। কারণ ভিসি মহোদয়ের নিয়োগের শর্ত মোতাবেক ক্যাম্পাসে অবস্থানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই বহুতল ভবন তৈরি করলে সকল চাহিদাই মেটানো সম্ভব। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায় ভিসি মহোদয়ের জন্য আবাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রয়োজন তুলনামূলকভাবে কম টাকার মাধ্যমেও তা সমাধান করা যেত। রিপোর্টের সুপারিশে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট শর্ত থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পাস তথা ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায় ভিসি মহোদয়ের আবাসিক ভবন তৈরির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে ঢাকার সংশ্লিষ্ট এলাকায় অফিস কাম আবাসিক ভবন ক্রয়ে অর্থ ব্যয়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়োগের শর্ত মোতাবেক ক্যাম্পাসে ভিসি মহোদয়ের বাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিরীক্ষাকে জানাতে হবে। সর্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারকারী কর্মকর্তার প্রাপ্যতার বেশি জ্বালানি বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় ২২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ কাজে জড়িত টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিকট থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনিয়মিতভাবে উপাচার্যের নামে অতিরিক্ত গাড়ির জ্বালানি বাবদ-৫৮ লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলে বলা হয়েছে, উপাচার্য সচিব মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ায় একটি গাড়ি সর্বক্ষণিক ব্যবহারের অধিকারী। তার কার্যাদি নির্বাহের জন্য ঢাকা মেট্রো-ঘ-৩১-০৬১৬ ব্যবহার দেখিয়ে শুধু জ্বালানি বাবদ ৫ লাখ ৮২ হাজার ৬৮৫ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় দেখানো হয়েছে। তিনি একটি গাড়ি প্রাপ্য। আপত্তিকৃত টাকা আদায় করে প্রমাণসহ নিরীক্ষা অফিসে পাঠানো জন্য অনুরোধ করা হয়েছে রিপোর্টে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস, ২০০৮-এর ১৫(২) বিধান লঙ্ঘন করে গাড়ি ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ক্রয় মূল্য এক কোটি ৮৯ লাখ টাকা। স্পেসিফিকেশন তৈরিতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল ২০০৮ অনুসরণ করা হয়নি। অডিট রিপোর্টে সরকারের অর্থ ব্যয়ে আরও বেশ কিছু আপত্তি তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরিশোধিত সম্মানী বিলের ওপর ভ্যাট কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৮৮ লাখ ৩১ হাজার ৪২২ টাকা। অর্গানোগ্রামবহির্ভূত পদোন্নতিযোগ্য শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে পদোন্নতিসহ স্কেল প্রদান করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ লাখ ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা। অনিয়মিতভাবে অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে ৩ জন সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দিয়ে বেতন ও ভাতাদি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৯২ লাখ ৯ হাজার ৭৫ টাকা। বিধিবহির্ভূতভাবে উপ-রেজিস্ট্রার/সমমান পদের (৫ম গ্রেডভুক্ত, ২২২৫০-৩১২৫০) কর্মকর্তাদের ৪র্থ গ্রেড স্কেল (২৫৭৫০-৩৩৭৫০) সিলেকশন গ্রেড স্কেল হিসেবে প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ৪০ লাখ আট হাজার টাকা। পরিশোধিত বিলের ওপর ভ্যাট কর্তন না করায় রাজস্ব ক্ষতি ১ কোটি ৩৮ লাখ চার হাজার টাকা। অনিয়মিতভাবে কম মূল্যে কর্ণফুলী পেপার মিলসের ব্যবহৃত উত্তরপত্র বিক্রয়ে ক্ষতি ২৯ লাখ আট হাজার ৬১৭ টাকা।
×