ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খন্দকার জামিল উদ্দিন

ক্রিকেট কূটনীতির বিরস কাহিনী!

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২৩ মার্চ ২০১৬

ক্রিকেট কূটনীতির বিরস কাহিনী!

সবার যখন ধারণা টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ খুব একটা এগিয়ে নেই, ঠিক তখন এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলার মধ্য দিয়ে এই ফরমেটেও ভাল খেলার আত্মবিশ্বাসটা অর্জন করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ নিজেদের সেই বিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করার বড় একটা ক্ষেত্র ছিল টাইগারদের জন্য। কিন্তু এমন একটা অবস্থায় তাসকিন আহমেদ এবং আরাফাত সানিকে বোলিং এ্যাকশনের অভিযোগে নিসিদ্ধ হতে হলো। যা বিনা মেঘে বর্জ্রপাতের মতোই আঘাত হেনেছে সাধারণ দর্শকদের মনে। বিস্ময়কর বিষয় হলো বিশ্বকাপের মতো আসরে তাসকিন এবং সানির বোলিং এ্যাকশনের অভিযোগ এনে টুর্নামেন্ট চলাকালেই আবার তাদের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। আরাফাত সানির বিষয় অনেকেরই সংশয় ছিল। তবে তাসকিনের বিষয়ে কারও কোন দ্বিধা ছিল না। সবাই আশা করেছিল পরীক্ষার ফল বেরুলে তাসকিনকে আমরা মুক্ত দেখতে পাব। এমনকি তাসকিন নিজেও নিশ্চিত ছিল তার এ্যাকশনে কোন সমস্যা নেই। হাতুরুসিংহে (প্রধান কোচ), হিথ স্ট্রিকও (বোলিং কোচ) একই আশা প্রকাশ করছিলেন। হাতুরুসিংহে তো সংবাদ সম্মেলনে বলেই দিয়েছিলেন, ‘যদি তাসকিনের বোলিং নিয়ে সন্দেহ থাকে তবে আমার আইসিসির কর্মকা- নিয়েই সন্দেহ আছে।’ হাতুরুকে ধন্যবাদ এমন সাহসী কথা প্রকাশ্যে বলার জন্য। সত্যি বলতে হাতুরুসিংহের মতো আইসিসির প্রক্রিয়া নিয়ে এই একই প্রশ্ন আমার নিজেরও। আমার মনে হয় প্রশ্ন জমাট বেঁধেছে সাধারণ দর্শকদের মনেও। সবাই বিস্মিত, কারণ নিয়ম হচ্ছে কারও বিরুদ্ধে এ্যাকশনের অভিযোগ আনলে আম্পায়ারকে সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে কোন বলটার বিষয়ে তিনি সন্দিহান। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম তাসকিনের বিষয়ে এ রকম কোন কথা আম্পায়ারদের রিপোর্টয়ে বলা নেই। শুধু বলা আছে তাসকিনের বোলিংয়ের বিষয়ে তারা সন্দিহান। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন বলের কথা সেখানে উল্লেখ নেই। তাসকিন আহমেদকে নিজের এ্যাকশনের পরীক্ষা দিতে গেলেন। এখানেও বিস্ময়করভাবে আইসিসি খুব তড়িঘড়ি করেই পরীক্ষার ফলটা দিয়ে দিল। এভাবে আগে কখনও এ রকম কোন পরীক্ষার ফল দেয়া হয়েছে বলে আমর মনে জানা নেই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে হল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচে তাসকিনের ওপর অভিযোগ আনা হয়েছিল সে ম্যাচে তিনি কোন বাউন্সারই দেননি। অথচ তার এ্যাকশন-পরীক্ষার সময় তিন মিনিটে তাকে ৯ বাউন্সার দিতে বলা হলো! যেখানে কি না ম্যাচে চার মিনিটে একটা ওভার কাউন্ট করা হয়। তিন মিনিটে ৯টা বাউন্সার দেয়া মানে একেকটি বল করার পর দ্রুত তাকে বোলিং প্রান্তে ফিরতে হয়েছে এবং পরের বল করার জন্য আবারও দৌড়াতে হয়েছে। অর্থাৎ পুরোপুরি অমানবিক একটা পরীক্ষা নেয়া হয়েছে তাসকিনের। যা কোনভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়। তার বাউন্সার নিয়ে প্রশ্ন তুলা হলেও নরমাল বলগুলোতে কখনও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী যদি সাধারণ বলগুলোতে কোন সমস্যা না থাকে তবে তাকে শুধু সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু তাসকিনের বেলায় আমরা অইসিসিকে সেই পথে হাঁটতে দেখলাম না। হাটবে কি করে? আম্পায়াররা যে বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছেন সেই বিষয়েই তো তার পরীক্ষা নেয়ার কথা। কিন্তু আম্পায়াররা তো এখানে সুুনির্দিষ্টভাবে কোন বলের কথাই উল্লেখ করেনি। তার মারে নৈতিকভাবে তাসকিনের কোন পরীক্ষাই হওয়ার কথা না। অর্থাৎ তাসকিনের পরীক্ষা নেয়ার পক্রিয়াটা সম্পূর্ণ ভুল, যার মধ্য দিয়ে এই নবীনকে যেতে হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে আইসিসি ধরেই নিয়েছিল তাকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ কারণেই তিন মিনিটে তাকে দিয়ে ৯ বাউন্সার করানো হয়েছে। যাতে কোন বাউন্সারে একটু ভুল পেলেই নিষিদ্ধ করা যায়। তাসকিনকে নিষিদ্ধ করার এই পক্রিয়াটাই তাই অবৈধ। বিষয়টা অনেকদিন ধরেই আমরা লক্ষ্য করছি যে এই উপমহাদেশ বা তিন মোড়লেই বাইরের কোন দলের বোলার যখন মোড়লদের সমস্যায় ফেলে দেয় তখনই তার পেছনে লেগে যাওয়া হয়। এক সময় আমরা দেখেছি মুরালি ধরনের জন্য অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে টিম নিয়েই মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। রানাতুঙ্গা তখন আইসিসির নাম দিয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম কাউন্সিল। এনকি বিসিসিআইয়ের অন্য নাম হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন। সুতরাং এখানে যে ভারতের চক্রান্ত কতখানি সেটা দীর্ঘদিন আগে বলা রানাতুঙ্গার ওই কথা থেকেই পরিষ্কার হওয়া যায়। সুনিল নারাইন যখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছিল, ভারতীয়রা খেলতেই পারছিল না তার বিরুদ্ধে, তখন নারাইনকেও একই প্রক্রিয়ায় বাদ দেয়া হয়েছিল। সাইদ আজমল যখন ত্রাস হয়ে দাঁড়ালো তাকেও একই প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা হলো। এ্যাকশন শুধরে পরে যিনি আর নিজের ছন্দে ফিরতেই পারল না। একইভাবে আমাদের সোহাগ গাজী এবং আব্দুর রাজ্জাক যখন প্রতিপক্ষের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো তখন তাদেরও এই নীল নক্সার ফাঁদে পড়তে হলো। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার কোন বোলারদের বিষয়ে কাখনও কোন প্রশ্ন উঠে না। অথচ এই তিন টিমেও এমন অনেক বোলার আছে যাদের এ্যাকশন পরীক্ষা করলে দেখা যাবে তাদের কনুই ২০ ডিগ্রীর বেশি বেঁকে যায়। মজার বিষয় যে রড টাকার তাসকিনের বোলিংয়ের বিষয়ে অভিযোগ করেছে সেই রড টাকার এই ক’দিন আগেও বাংলাদেশেই আম্পায়ারিং করে গেছে। তখন তিনি কোন অভিযোগ করেননি। সেই একই আম্পায়ার পরের টুর্নামেন্টেই কিভাবে একই বোলারের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে? এ রকম আরও নানা বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখানে একটা নীল নক্সার বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আমরা উঠতি জাতিগুলো যখনই বড় দলগুলোর জন্য হুমকি হয়ে ওঠি তখনই আমাদের পেছনে চক্রান্ত শুরু হয়ে যায়। যে চক্রান্ত আগে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও করা হয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে আইসিসির কোন কিছুর উপরেই আর মানুষের আস্থা থাকবে না। সবচেয়ে শঙ্কার কথা হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে ক্রিকেটের উপরই মানুষের ভালবাসা কমে যাবে। গ্লোবালাইজেশনের যুগে ক্রিকেটকে গুটি কয়েক দেশের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা চলছে এখন। তিনটা-চারটা দেশ নিয়ে তো আর একটা বিশ্বকাপ বা কোন খেলা হতে পারে না। জানি না এই বোধ আইসিসির কবে হবে। আজকে যখন ফুটবল বিশ্বকাপে ৩২ দল খেলে, বিভিন্ন বাছাই পর্ব পেরিয়ে তারপর আসতে হয়, তখন বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় কি না দশ নিয়ে। এই যে সহযোগী দেশ, যাদের বিষয়ে বরাবরই নাক ছিটকানো ভাব আইসিসির। এটা কেন হবে? ধর্মশালায় নিয়মিত বৃষ্টি হয় জেনেও কেন বাছাই পর্বের খেলা সেখানে আয়োজন করা হবে? এভাবে কি ক্রিকেট সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে পারবে? মনে রাখতে হবে এই উপমহাদেশে ক্রিকেট না থাকলে শুধু ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া দিয়ে ক্রিকেট চলবে না। তখন শুধু ভারতে ওপরই নির্ভর করতে হবে। এখনই যেমন অনেকটা হয়ে পড়েছে। শুধু ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ক্রিকেটটা খেলবে আর কেউই খেলবে না এ রকম একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেন আইসিসি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। নয়লে ইদানীং ক্রিকেট থেকে অক্রিকেটিয় বিষয় কেন বেশি সামনে আসছে? গত বিশ্বকাপেও আমরা এমনটাই দেখেছি। এবারও একই চিত্র দেখছি। বিশ্বকাপের মাঝখানে এভাবে যদি অক্রিকেটিয় বিষয় এসে হানা দেয় তখন ক্রিকেটের মূল রস আশ্বাধনের যে বিষয় থাকে সেটা হারিয়ে যায়। এই যে তাসকিন-সানির পরীক্ষা নেয়া হলো এটা তো বিশ্বকাপের পরও হতে পারত। খেলার গুণগত মান, খেলাকে আকর্ষণীয় করার বিষয়ে মনে হয় না আইসিসি খুব বেশি চিন্তিত। বরং তারা বেশি চিন্তিত বাংলাদেশের মতো নবীন শক্তিগুলোকে কিভাবে ডাবিয়ে দেয়া যায় সেটি নিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে ক্রিকেট তার মূল সুর হারিয়ে ফেলবে। ক্রিকেটের যে ঐতিহ্য সেটিও ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাবে। এই জিনিসগুলো নিয়ে আইসিসিকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। বর্তমানে যিনি আইসিসির প্রধান- শশাঙ্ক মনহর, তিনি খুবই বিচক্ষণও ব্যক্তি। ভারতের একজন বিখ্যাত আইনজীবীও বটে। উনি দায়িত্ব নেয়ার পরই তিন মোড়লের কর্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার সেই বক্তব্যে প্রেক্ষিতেই আমার চাওয়া- বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) যেভাবে আইসিসির সামনে যুক্তি তুলে ধরেছে তিনি অবশ্যই সেটি বিবেচনা করবেন। এর আগে আমরা দেখেছি জগমোহন ডালমিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপে ১৯৯৯ সালে শোয়র আক্তারকে একই পরিস্থিতি থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তাসকিনের বিষয়ে শশাঙ্ক মনোহর একই পথে হাঁটবেন আশা করি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটও তার স্বমহিমা এবং আপন গতিতে ফিরবে আশা করি। অনুলিখনঃ তোফায়েল আহমেদ
×