ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঝিনুক থেকে চুন উৎপাদনে জড়িত সাড়ে ৩ হাজার পরিবার নানা সঙ্কটে

গাইবান্ধায় হারিয়ে যাচ্ছে যুগি পেশা

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৩ মার্চ ২০১৬

গাইবান্ধায় হারিয়ে যাচ্ছে যুগি পেশা

আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা ॥ খাল, বিল, নদী থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে, নানা পদ্ধতিতে যারা চুন তৈরি করে তারা হলো যুগি সম্প্রদায় বা চুনার। হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় যুগি পরিবার এখনও গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় তাদের আদি পেশাকে আঁকড়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার ঝিনুক থেকে চুন উৎপাদনকারী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পেশাজীবী পরিবার নানা সমস্যা সঙ্কটে পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। কিন্তু নদ-নদী ও খাল-বিলে ঝিনুকের সংখ্যা কমে যাওয়া, চুনা পাথর থেকে তৈরি চুনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় যুগিদের তৈরি চুনের চাহিদা হ্রাস এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া, আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে পেশাদার যুগিরা জীবিকার তাগিদে পৈত্রিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালুয়ার বাজার সংলগ্ন যুগিপাড়া গ্রামটি ঝিনুকের চুনের কারিগরদের কারণে ইতোমধ্যে চুনের গ্রাম নামেই পরিচিত অর্জন করেছে। যুগিপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রায় ২শ’ ৩০টি পরিবারের বসতি ছিল। যারা ঝিনুকের চুন তৈরি করে খুব সচ্ছল জীবনযাপন করত। কেননা, সে সময় চারদিকে নদীবেষ্টিত এ জেলায় ঝিনুক পাওয়া যেত অনেক বেশি। উৎপাদিত চুন এখান থেকে যেত পার্শ্ববর্তী জেলায়। ফলে দাম বেশি পাওয়া যেত বলে তখন চুনের কারবার ছিল রমরমা। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নেই। সম্প্রতি রামচন্দ্রপুরের যুগিপাড়ায় মাত্র ৫৫টি পরিবার তাদের পুরাতন এই চুন তৈরির পেশাকে আঁকড়ে রেখেছে। পরিবারের নারী-পুরুষ মিলে চুন তৈরিতে নিয়োজিত থাকে। যুগিরা ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী বালাসীঘাট, কামারজানি, করতোয়া নদীর বড়দহ ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে নদীর ঝিনুক কেনে। মাছ ধরার সময় জালে যে ঝিনুক ওঠে, স্থানীয় ভাষায় সেগুলোকে বলা হয় ‘সিপি’ বা ‘টোকরাই’। জেলেরা তা জমা করে রাখে যুগিদের জন্যই। তারপর এগুলোকে তারা গরম পানিতে সিদ্ধ করে, যাতে সেগুলো মরে যায় এবং এতে সহজেই খোলসা দুটো ফাঁক হয়ে খুলে যায়। এরপর যুুুুগি পরিবারের মেয়েরা প্রতিটি ঝিনুক থেকে ভেতরের নরম অংশগুলো বের করে নেয়। যা হাঁস-মুরগির খাবার হিসেবে বিক্রি হয়। এ অবস্থায় ঝিনুক এর খোলসাগুলো পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। সবশেষে চুনের ভাটিতে আগুনে পুড়িয়ে তা ছাই করা হয়। ইদানিং সমুদ্রের সাদা শঙ্খ এবং সাদা রঙ্গের ঝিনুক থেকেও চুন তৈরি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বগুড়াসহ অন্যান্য জেলায়। যে চুনে এ্যাসিড মিশিয়ে সাদা ধব্ধবে করা হয়। আর যুগিদের চুনে কোন রাসায়নিক উপকরণ মেশানো হয় না বলে তার রং হয় একটু কালচে। সাদা শঙ্খের চুনের দাম বেশি হলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না যুগিদের বানানো চুন। আদি চুন শিল্পী কান্তেশ্বর, বিষ্ণু, গোবিন্দ যুগিদের দাবি, আর্থিক কারণে তারা আদি এই গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারছে না। এ জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়া হলে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে এবং এই ঝিনুকের চুন শিল্পও বিকশিত হবে।
×