ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই ;###;পুলিশের নজরদারি কমেছে, বিআরটিএও নিষ্ক্রিয় ;###;২২ মহাসড়কে ফের অটোরিক্সা, নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ সব অযান্ত্রিক যানবাহন

নিষিদ্ধ যান চলছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নিষিদ্ধ যান চলছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নিরাপদ করা যায়নি মহাসড়ক। ইতোমধ্যে কেটেছে প্রায় সাত মাস। অথচ নিষিদ্ধ পরিবহন চলাচল বন্ধে সরকারী নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা করছেন না পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তেমনি পুলিশের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে নজরদারি কমেছে। তৎপরতা নেই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃপক্ষেরও। বাস্তবতা হলো সব পক্ষের মধ্যে আপোস আপোস খেলায় ফের মহাসড়কে উঠেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সব রকমের পরিবহন। একারণে সড়ক দুর্ঘটনাও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তও আলোর মুখ দেখল না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতেই অটোরিক্সা, নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ অযান্ত্রিক যানবাহন অবাধে চলছে। এক পর্যায়ে সরকার ২২টি মহাসড়কে এসব পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ করে। সে নির্দেশনাও টিকেনি। এখন শুধুমাত্র কাগজপত্রে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দাবি সিদ্ধান্তের ৯০ ভাগ কার্যকর করার। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সরবে বন্ধ হয়ে নীরবে আবার নিষিদ্ধ পরিবহন চালু হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। স্বল্পগতির এসব পরিবহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা আরও বাড়বে এমন আশঙ্কা তাদের। ব্যাপক প্রচার চালিয়ে গত ১ আগস্ট ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার। এসব যানের মালিক-শ্রমিকদের প্রতিবাদে মহাসড়কে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। এমন বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কিছুটা পিছু হটে সরকার। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ২২টি মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অটো টেম্পো এবং অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এবং মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা বিধানে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব জাতীয় মহাসড়ক ছাড়া অন্য আঞ্চলিক সড়ক বা জেলা সড়কে অটোরিকশা চলাচলে বাধা নেই বলে জানান তিনি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, অটোরিকশা, টেম্পোসহ কম গতির তিন চাকার যানবাহনকে মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে গত ১ আগস্ট থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এতে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমেছে বলেও দাবি করেন মন্ত্রী। দেশের আড়াই লাখ কিলোমিটার জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা ও গ্রামীণ সড়ক রয়েছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক-মহাসড়কের পরিমাণ ২১ হাজার কিলোমিটার। আর জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের আড়াই লাখ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের অধীন। এর মধ্যে তিন হাজার ৮১২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকা নিষিদ্ধ। অন্যত্র চলতে বাধা নেই। ভবিষ্যতে মহাসড়কে ধীরগতির গাড়ির জন্য পৃথক লেন হবে। কিন্তু মহাসড়কে আর তিন চাকা ফিরবে না। ওবায়দুল কাদের বলেন, বিগত পাঁচ বছরে বন্ধ করা যায়নি। আমি দুই মাসে ৯০ ভাগ বন্ধ করে দেখিয়েছি। সময় দিন, বাকিটাও করব। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অন্তত ২০টি পয়েন্টে এসব পরিবহন চলতে দেখা গেছে। আছে প্রায় শতাধিক টার্মিনাল। খোদ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসব পরিবহনের দেখা মিলবে শত ছাড়িয়ে হাজারে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিভিন্ন হাইওয়েতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে অথচ সরকার বলছে, এসব পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি সিলেটে গিয়ে এ দৃশ্য দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সড়ক বিভাগ এ ব্যাপারে কিছু বলছে না। সবাই দেখেও না দেখার ভান করলে যাত্রীসহ পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দুর্ভোগ কোনদিনই লাঘব হবে না। তিনি জানান, গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব মহাসড়কে অটোরিক্সাসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করছে। বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি রুস্তম আলী জনকণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুট ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিষিদ্ধ পরিবহন নিয়মিত চলাচল করছে। এছাড়া এসব মহাসড়কে একটু পর পর বাজারসহ স’ মিলের শেষ নেই। রাস্তার ওপর রাখা হচ্ছে কাঠ। অবৈধ টার্মিনাল তো আছেই। এসব সমস্যা দূর করতে দ্রুত সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তিনি। ২২ মহাসড়কেই চলছে নিষিদ্ধ পরিবহন ॥ দেশের প্রধান ২২টি জাতীয় মহাসড়কে সিএনজিচালিত তিন চাকার যানবাহন, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সাত আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়েল পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব মহাসড়কের নাম উল্লেখ করা হয়। এই ২২টি প্রধান মহাসড়ক ছাড়া অন্যান্য আঞ্চলিক ও জেলা সড়কে অটোরিকশা চলাচলে কোন বাধা নেই।’ যেসব মহাসড়কে অটোরিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন নিষিদ্ধের কথা জানানো হয়েছে সেগুলো হলা- এন-১ : কাঁচপুর সেতু থেকে মদনপুর-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম-রামু (কক্সবাজার), এন ২ : কাঁচপুর সেতু-ঢাকা-ভেলানগর (নরসিংদী)-ভৈরব-সরাইল-মাধবপুর-মিরপুর-শেরপুর-সিলেট বাইপাস, এন ৩ : জয়দেবপুর চৌরাস্তা-ময়মনসিংহ বাইপাস পয়েন্ট, এন ৪ : জয়দেবপুর চৌরাস্তা-টাঙ্গাইল-জামালপুর, এন ৫ : আমিনবাজার সেতু ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া ঘাট-খয়ের চর ঘাট-কাশিনাথপুর-হাটিকুমরুল-বগুড়া বাইপাস-রংপুর বাইপাস- সৈয়দপুর বাইপাস-দশমাইল (দিনাজপুর)-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা, এন ৬ : কাশিনাথপুর (পাবনা)-পাবনা বাইপাস-দাশুরিয়া-নাটোর বাইপাস-রাজশাহী বাইপাস-নবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ-বালিয়াদিঘী স্থলবন্দর, এন ৭ : দৌলতদিয়া-ফরিদপুর (রাজবাড়ি মোড়)-মাগুরা-ঝিনাইদহ বাইপাস-যশোর বাইপাস-খুলনা সিটি বাইপাস-মংলা, এন ৮ : তেগোরিয়া মোড় (ঢাকা)-মাওয়া-কাওরাকান্দি-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী, এন ১০২ : ময়নামতি (কুমিল্লা)-ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাইপাস-সরাইল, এন ১০৫ : মদনপুর-ভুলতা-মীরের বাজার-বোগড়া-কড্ডা (ঢাকা বাইপাস), এন ৪০৫ : এলেঙ্গা-নলকা-হাটিকুমরুল, এন ৫০২ : বগুড়া-নাটোর, এন ৫০৬ : রংপুর-বড়বাড়ি-কুড়িগ্রাম, এন ৫০৭ : হাটিকুমরুল-বনপাড়া, এন ৫০৯ : বড়বাড়ি-লালমনিরহাট-বুড়িমারী, এন ৫৪০ : নবীনগর-ইপিজেড-চন্দ্রা, এন ৭০২ : যশোর-মাগুরা, এন ৭০৪ : ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-দাশোরিয়া, এন ৭০৬ : চাষাড়া মোড় (যশোর)-বেনাপোল, এন ৮০৪ ও ৮০৮ : ভাঙ্গা-ফরিদপুর বাইপাস-রাজবাড়ী মোড়, এন ৮০৫ : ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া-মোল্লার হাট-ফকির হাট-নোয়াপাড়া, এন ৮০৬ : ভাটিয়াপাড়া-কালনা-লোহাগড়া-নড়াইল-যশোর। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, উন্নত দেশগুলোর মহাসড়কে অযান্ত্রিক কিংবা স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশে অপরিকল্পিতভাবে সড়কগুলো নির্মাণ হয়েছে। অযান্ত্রিক বা স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের বিষয়টি মাথায় না রেখেই সড়ক হয়েছে। অথচ পৃথক লেন করে দিলেই সমস্যার সমাধান হতো। তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে মহাসড়কের সঙ্গে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলে পৃথক লেন করার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, এই টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪০টি রুটে বাস চলাচল করে। সকল রুটেই অটোরিকশাসহ অনুমোদনহীন যানবাহন চলছেই। ঢাকা-টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ-পাবনা-রাজশাহী-বগুড়া-ময়মনসিংহ-সিলেট-কুমিল্লা সহ গুরুত্বপূর্ণ সবকটি মহাসড়কে এসব যানবাহন নিয়মিত যাতায়াত করছে। আমরা সরকারকে বার বার এ বিষয়টি বলে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এসব পরিবহন চলাচলের কারণে আন্তঃজেলা রুটের পরিবহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারে না। মহাসড়কে চলছে ১৮ লাখ অনুমোদনহীন পরিবহন ॥ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮ লাখ নসিমন, করিমন, ভটভটি বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে। যার একটিও সরকারীভাবে অনুমোদিত নয়। ৩ লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক মহাসড়কে চলতে দিয়ে কোন অবস্থাতেই নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬টি যানবাহন প্রতিবছর মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ছে। এই পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬৯ জন। দুর্ঘটনার কারণে দেশের ২ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্যাঙ্ক লরি মালিক সমিতির নেতা রেজাউল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে অটোরিকশার স্ট্যান্ড রয়েছে। সুযোগ বুঝে অনেক সময় অটোরিকশাসহ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অন্যান্য পরিবহন মহাসড়কে আসে। সোনারগাঁও পয়েন্টে অবৈধ পার্কিং, ছোট ছোট বিভিন্ন গাড়ির সারিবদ্ধ লাইন তো আছেই। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধসহ নিরাপদ মহাসড়ক গড়তে তিন চাকার পরিবহন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-কুমিল্লা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-নরসিংদীসহ বিভিন্ন মহাসড়কে এসব পরিবহন আবারও ফিরে আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণে সরকার ৬০ ভাগ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে। এ ব্যাপারে আরও কঠোর হলে হয়ত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে যাত্রী দুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। অটোরিক্সা মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, মহাসড়কে এসব পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ করায় সারাদেশে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পেটের তাগিদে হয়ত এখন কেউ কেউ রাস্তায় নামার চেষ্টা করছেন। আমরাও সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। তবে বিকল্প বাস্তার ব্যবস্থা করে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। মহাসড়কের পাশে পৃথক লেন করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিকল্প চলাচলের ব্যবস্থা না করলে সরকার যতই চাপ প্রয়োগ করুক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
×