ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুরাইয়া ফারজানা

ভেনিস ॥ কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিক

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভেনিস ॥ কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিক

(পূর্ব প্রকাশের পর) খালের ওপর দু-একটা সীগাল উড়ে বেড়াচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এ্যাড্রিয়াটিক সাগরটি কাছে পিঠে। খুব পুরাতন কিছু বাড়ি আছে। দালানের বেশিরভাগ পলেস্তারা উঠে গেছে। দেখতে অনেকটা ঘোড়ার আস্তাবলের মতো। বাড়ির বারান্দাসংলগ্ন খাল। খালের পানি আর আশপাশের বসতি প্রায় একই সমতলে। জোয়ার-ভাটা বা অন্য কোন কারণে এখানকার জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় কি-না, জানা নেই। চারপাশে মুগ্ধ হয়ে তাকাই। যেন ইতিহাসের পাতা হতে উঠে আসা এক প্রাচীন নগরী। বড় অদ্ভুত লাগে! এই ভেনিসের প্রেক্ষাপটে সেক্সপিয়ার রচনা করেছেন ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘ওথেলো’র মতো অমর রচনা। এছাড়া বর্তমান হলিউডের বিখ্যাত কিছু ছবি, যেমন জেমস বন্ড সিরিয়ালের- ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ, ক্যাসিনো রয়্যাল, মুনর‌্যাকার; ইন্ডিয়ানা জোনস, হালের টম্ব রাইডারের মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের পটভূমি এই ভেনিস। আর ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল তো পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ফেস্টিভাল। সেই ১৯৩২ সাল হতে আজ অবধি প্রতি বছরের অগাস্টের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের শুরুতে এই উৎসব চলে। ভেনিসের লিড দ্বীপে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে চলচ্চিত্রে বিশেষ ভূমিকা বা অবদানের জন্য গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার প্রদান করা হয়। ভেনিসের আরেকটি অনন্য উৎসব হলো ভেনিস কার্নিভাল। একটু আগে সান্তা লুসিয়া ট্রেনস্টেশনের ট্যুরিজম অফিসের পাশের কিউরিও শপে এই কার্নিভালের মুখোশ দেখে এসেছি, বাংলাদেশী হকারের কাছ থেকে কিনেছিও। ভেনিসবাসীরা নানান রঙের ও ঢংয়ের এসব মুখোশ পরে এই উৎসব আয়োজনকে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য করে তোলে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পরে ভেনিসের সেনোরিটারা আরও আকর্ষণীয়া হয়ে ওঠে। কার্নিভাল উৎসবে মুখোশের আড়ালে যুবক-যুবতীরা যূথবদ্ধ হয়। কথিত আছে, স্থানীয় অপেরা হলে মুখোশ পরা ভেনিসীয় দম্পতি বা জুটি পরনারী বা পরপুরুষের সঙ্গে উদ্দাম অভিসারে মেতে ওঠে। প্রতি বছর জানুয়ারির ২৬ থেকে ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ পর্যন্ত চলে ভেনিস কার্নিভাল। দুই সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবে মোমের আলোয় বোট প্যারেড, কনসার্ট, স্ট্রিট শো, ভ্যালেন্টাইন অনুষ্ঠান পালিত হয়। তবে আজকের এই ভেনিস কার্নিভালের উৎপত্তির মূলে কিন্তু রয়েছে ধর্মীয় আচার। এক সময় লেন্ট অর্থাৎ যিশুখ্রিস্টের উপবাস উপলক্ষে খ্রীস্টানরা এ্যাস ওয়েনেসডে থেকে ইস্টার ইভের আগ পর্যন্ত মোট ৪০ দিন উপবাস করত। এ সময় ধর্মপ্রাণ খ্রীস্টানরা মাংস, চিনি, চর্বিজাতীয় খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকত। কার্নিভাল কথাটি লাতিন ‘কার্নি’ ও ‘ভ্যাল’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ফেয়ারওয়েল টু মিট। অর্থাৎ মাংস গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। এই দীর্ঘ সংযমের পূর্বে ভেনিসবাসীরা কার্নিভালের আনন্দ আয়োজন করে। বারো শতকের মাঝামাঝিতে বীর দেশপ্রেমিক এ্যাক্যুলিয়ার বিজয় উৎসব উপলক্ষে ভেনিসে প্রথম কার্নিভাল শুরু হয়। আঠারো শতকে এই জনপ্রিয় উৎসবটি লুপ্ত হয়েছিল। অস্ট্রিয়ার কাছে ভেনিসের পরাজয়ের পর ‘মুখোশ পরে কার্নিভাল’ উৎসবটি মুখথুবড়ে পরে। পরবর্তীতে ইতালির শাসক মুসোলিনি কার্নিভাল নিষিদ্ধ করেন। তবে ১৯৭৯ সালে স্থানীয় কারুশিল্পীদের বিশেষ উদ্যোগে ভেনিসবাসীরা বিস্মৃতপ্রায় মাস্ক পরে কার্নিভাল উদযাপনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনে। আমাদের ওয়াটারবাসটি পো এবং পিয়াভ নদীর মোহনায় এসে পড়ল। চারদিকে রাশি রাশি পানি। যেন কোন কূল-কিনারা নেই। দূরে বিন্দু বিন্দু নগর, গির্জার চূড়া দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নগরটি পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল মোহনায় এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলো সব ফাইস্টার, সেভেনস্টার হোটেল। বিশ্বের মিলিওনার-বিলিওনার পর্যটকদের আকর্ষণ করতে কতই না মনোহারী এসব আয়োজন, যা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। নিকটবর্তী এ্যাড্রিয়াটিকের হিমঠা-া বাতাসে দিশাহারা হয়ে পড়লাম, ডেক ফেলে ওয়াটারবাসের ভেতরে গিয়ে ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে, হ্যান্ডগ্লাভস পরে জুত হয়ে বসলাম। তবু শীতের কামড় থেকে রেহাই নেই। সামনের সেন্ট এলেনায় আমাদের স্টিমারটি থামবে। কিন্তু জায়গাটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। প্রচ- ঠা-ায় এতটাই কাবু যে, ইচ্ছা করছে এখনই মেস্ত্রেতে হোটেলে ত্রিস্তারের ভারি জানালা আঁটা রুমটিতে ফেরত যাই। সেন্ট এলেনায় নেমে প্রায় দৌড়ে ওয়াটারবাস টার্মিনালটি পার হয়ে নগরের ভেতর ঢুকলাম। হন্যে হয়ে কফি হাউস খুঁজতে লাগলাম। ক্ষুধাটাও বেশ চাড়া দিয়ে উঠেছে। রাস্তার পাশে পাতা বেঞ্চিতে লাঞ্চ করতে বসে গেলাম। সান্তা লুসিয়া থেকে কিনে আনা খাবারের মোড়কটা বের করলাম। তুলতুলে সুস্বাদু পনির আর স্পিনাচ ঠাসা পিৎজাটি মুখে দিয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। সাধেই কি বলে ইতালিয়ান ক্যুইজিন বিশ্বসেরা! রোমান, বাইজেন্টাইন, ইহুদী ক্যুইজিনের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছে ইতালিয়ান শেফরা। উপকরণের তেমন ঘনঘটা নেই। আলু, টমেটো, ভুট্টা, ক্যাপসিকাম, চিজ, অলিভ কিংবা অলিভঅয়েল- এরকম মাত্র চার থেকে আটটি উপকরণ দিয়ে এদের শেফরা যে কারিশমা দেখাচ্ছে, তা এক কথায় অসাধারণ। কাছেই এক কফি হাউসে ঢুঁ মারলাম। কাঁচ ঢাকা কফি হাউস থেকে পো আর পিয়াভ নদীর মোহনা আর জেটির অনেকখানি দেখা যায়। এয়ারকন্ডিশন্ড রুমের মৃদু উষ্ণতায় ক্রিম কফি খেলাম আয়েশ করে। কফি খেয়ে ভেনিসের শেষ প্রান্তের এ জায়গাটি দেখতে বেড়ালাম। দূর থেকে যে নগর খুব প্রাচীন দেখায়, কাছাকাছি যেতে দেখি সেটা বেশ আধুনিক আর ছিমছাম। এ দিকটায় প্রচুর শপিং সেন্টার। কিছু কিছু দোকানে সেল লেখা ঝুলছে। প্রচ- ঠা-ার কারণে এই এলাকা ঘুরেফিরে দেখার আগ্রহ হারালাম। টার্মিনালে আসার পথে একটা ছোট্ট চার্চের পাশে ‘কারিতাস’র অফিস দেখলাম। দেশে থাকতে একবার অফিসিয়াল ট্যুরে টেকেরহাট যাওয়া হয়েছিল। সেখানে মধুমতী বিলের ধারে কারিতাসের বড় একটা অফিস দেখেছিলাম। আশপাশের দু-একটি চার্চে বেড়ানোর সুযোগ হলেও ক্যাথলিক চার্চভিত্তিক কারিতাসের জনকল্যাণমূলক কর্মকা- দেখার সুযোগ হয়নি। আজ ভেনিসের সেইন্ট এলেনা দ্বীপে কারিতাসের অফিস দেখে কেন জানি কিছুটা নৈকট্য অনুভব করলাম। টার্মিনালটিতে পৌঁছে দেখি পরবর্তী ওয়াটারবাস আসতে পনেরো মিনিট বাকি। টার্মিনালের সামনের খোলা অংশটুকু দিয়ে হু হু করে আসা ঠা-া বাতাসে হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ওয়াটারবাস এসে গেলে দ্রুত এর ভেতরে গিয়ে বসলাম। ওয়াটারবাস সান্তা লুসিয়ার পথে রওনা হলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ওয়াটারবাসের ভেতর যাত্রীরা সকলেই বেশ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। আমাদের সামনে এক কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার বসে আছে। দুই মেয়ে আর মা-বাবা। সবাই কেমন ঝিমাচ্ছে। তবে ছোট মেয়েটি ঘ্যান ঘ্যান করছে- মামি, আই ওয়ানা টু গো হোম। আ’ম টায়ার্ড। আই ফিল সিøপি। মোহনায় কূল-কিনারাবিহীন হয়ে কিছুক্ষণ রইলাম। এক সময় মোহময় ভেনিসের পুরনো সব দালানকোঠার দেখা মিলল। ওয়াটারবাস থেকে নেমে আবারও অনেক বাংলাদেশী হকার চোখে পড়ল। হাতে সেই মামুলি জিনিসপত্র- ব্যাগ, ছাতা। চোখে চোখ পড়লে এগুলো কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। আমরা তো এখানে ছাতা-ব্যাগ কিনতে আসিনি। তাছাড়া কাকে ফেলে কার জিনিসটা কিনব। তাই তাদের বিমুখ করতেই হলো। শুধু এক বাংলাদেশী ফেরিওয়ালার কাছ থেকে গন্ডোলার কয়েকটি স্যুভেনির কিনে স্টেশনের দিকে চললাম। সান্তা লুসিয়া রেলস্টেশনে এসে পৌঁছতেই ঝুপ করে রাত নামল। ভেনিস নামের প্রাচীন নগরটি আলো-আঁধারিতে ঢেকে গেল।
×