সময়ের বিবর্তনে আজ একান্নবর্তী পরিবারের কনসেপ্ট থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। অথচ এক সময় যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা আপনজনদের পরস্পরের সান্নিধ্যে থেকে ফিল করার আবেগ-অনুভূতি বাঙালী সংস্কৃতিরই অংশ ছিল।
চারপাশে তাকালে দেখতে পাই বাঙালী পরিবারগুলো পরিবেশগত কারণে আজ একজন থেকে আরেকজন কতটা দূরে। যে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিলিয়ে গেল তা যেন কেউ টেরই পায়নি। পরিবারের আকাশে কদাচিৎ দু-একটা নক্ষত্রের দেখা মিললেও নেই সেখানে প্রাণবন্ত আবেগ আর আবেশ। জরাজীর্ণ দিবসের কর্মমুখরতা ছাড়া এই স্বেচ্ছা নির্বাসিত অপরিসর মর্মের গহীনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের ধ্বনিটাই যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে। বিশেষ করে নগরজীবনে পরিবার বলতে সবকিছু ছকে বাঁধা। নগরজীবনের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন তথা জীবনের প্রতিটি ছত্রে জেগে আছে নড়বড়ে প্রহরের ছত্রখান গল্প। যে গল্পের শুরু আর শেষার্ধেও নেই উজ্জীবনের প্রাণোচ্ছলতা। খ-িত জীবনবোধের ভেতরেই যেন থমকে গেছে প্রজাপতি মন।
অথচ একটা সময় ছিল যখন পরিবারের সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা, এক হাঁড়িতে রান্না আর এক বৈঠকে খাওয়া পর্ব হতো অপরিসীম আনন্দ ভাগ করে। সেটা কবে? তিন দশক, চার দশক কিংবা পাঁচ দশক আগের কথা। তখন বাড়ির কর্তার আদেশ-নির্দেশে ভরপুর থাকত ভালবাসার টান, অনুশাসনের রাঙ্গা চোখ, মায়ের বকুনি, মুরুব্বিদের খবরদারি। এখন সেখানে পড়ে আছে ফড়িংয়ের ছিন্ন পালকের করুণ বিবর্ণ ছন্দ। যে ছন্দে নেই গীতলতা, নেই ধারা বহমানÑ তার কুল কুল শব্দপুঞ্জ।
এখন ‘সেলফ ফ্যামিলি ম্যানারিজম’ সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। বাঙালী যেন ভুলতেই বসেছে জয়েন্ট ফ্যামিলি তথা একান্নবর্তী পরিবারের জাদুময় সেই সব দিনের কথা। শহুরে নতুন প্রজন্ম প্রকৃতির অপূর্বময়তার সংস্পর্শ থেকে যেমন আজ বঞ্চিত। একই ভাবে পারিবারিক বন্ধনের রূপটাও কখনও তেমনভাবে তারা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায়নি। ফলে ঈদ কিংবা অন্যান্য ছুটির সময় শুধু শহুরে জীবন-জীবনের প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে এক রত্তি বউ বাচ্চার সংসার, লাগেজ গুছিয়ে-মুছিয়ে ছোটে লঞ্চ, ট্রেন, বাস, স্টিমার, নিজেদের গাড়িতে করে শিকড়ের টানে গ্রামের পথে। যে পথের ধুলো আর ঘাসে রোদ আর শিশিরের এক অদ্ভুত কার্নিভাল ফুটে ওঠে।
আগের মতোই পড়ে থাকল জীবন সায়াহ্নে পরিচর্যাহীন একাকী সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-পরিজনহীন বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা। আমাদের সমকালীন সাহিত্য, চলচ্চিত্র, গল্প, নাটক, শিল্পকর্মেও যেন একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটা আগের মতো আর উজ্জ্বল বৈভবে ফুটে উঠছে না। পাওয়া যাচ্ছে না সেই রিদম্। ডিজিটাল সময় যেন সবকিছুকেই ডিজিটালাইজড করে দিচ্ছে ক্রমাগত। পরিবার, সম্পর্ক, হৃদ্যতা চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। মোবাইল ফোনের নীল মনিটরে। বাটন চাপলেই ভেসে উঠছে প্রিয় কারও নাম। যে নামটি ছিল একদিন একে অন্যের মধ্যে জড়িয়ে। তা যেন আজ এক পঙ্ক্তি কথোকথনের মধ্যেই হয়ে গেছে সীমাবদ্ধ। পরিবারকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ঝর্ণায় ছিল বাঙালী সিক্ত, সেখানে জমেছে যেন বিচ্ছিন্নতার গল্পহীন ধুলোর আস্তরণ। আবেগের পলেস্তরাগুলো ক্রমশ উঠে যেতে বসেছে। পড়ে আছে চুনকামহীন একান্নবর্তী পরিবারের সেই মর্মছোয়া বিমর্ষ অনুভূতি। নাগরিক জীবনে বহুকাল ধরে জীবন এখন একচিলতে বারান্দা, একরত্তি জানালা আর মুক্ত আকাশবিহীন আচ্ছাদনের ঘেরাটোপে আবৃত হয়ে আছে। পারিবারিক সম্পর্কের স্বপ্ন এখানে ধুলো জমা, পিয়ানো, গিটার, ভায়োলিন, সেতার, এস্রাজ, তানপুরা-হারমোনিয়ামের অবয়বের মতো অবরুদ্ধ। খয়েরী শালিকের রোয়াজ্বলা সেই বিকেল কই এখানে। তবুও জীবন তো চলমান।
বিলুপ্তপ্রায় আজ একান্নবর্তী পরিবারের চালচিত্র। বিচ্ছিন্ন আজ শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা। তারুণ্য-যৌবনের উচ্ছ্বাস আজ যেন কুয়াশা মোড়ানো কান্নার আওয়াজ আর হাহাকার ভরা এক বিস্তৃত অরণ্যের ভারি দীর্ঘশ্বাসে গেছে ভিজে! মায়ের আদর, বাবা, কাকা, জ্যাঠার স্নেহ; জেঠিমা, চাচি আম্মার অফুরন্ত স্নেহলতার স্পর্শ কি আজ আর আছে আগের মতো? বাড়ির সব ভাইবোন মিলে সেই উৎসবমুখর ভালবাসাময় প্রহর যেন থমকে আছে গোধূলির রঙে। মফস্বল কিংবা গ্রামে আজও এক-আধটু যৌথ পরিবারের মৃদু ঝল্কানি চোখে ভাসলেও যেন তাতেও লেগেছে ক্ষয়িষ্ণু চন্দ্রগ্রহণ। যেন অক্সিজেনের ওপর ভর করে জয়েন্ট ফ্যামিলির চিরায়ত সেই আবেগটুকু জীবনের প্রবহমানতাকে ধরে রেখেছে। যদিও ওই আবেগের বুকে ইতোমধ্যে মর্চে পড়তে শুরু করেছে। যেন ভেঙ্গে চৌচির হয়ে পড়েছে দাদাজীর ভাঙ্গা ফ্রেমওয়ালা চশমার ঘোলা কাঁচ। একান্নবর্তী পরিবারের অকৃত্রিম সুখানুভূতিগুলো বিলীন হতে হতে আজ একখ- মেঘের টুকরার মতো ভেসে আছে হৃদয়ের বিষণœ আকাশে।
আর তাই হয়ত এমন সময় নিকট দূরে অপেক্ষমাণ, যখন নতুন প্রজন্ম একান্নবর্তী পরিবার কিংবা জয়েন্ট ফ্যামিলির বাস্তবিক রূপটাই যাবে ভুলে।
যেভাবে এই প্রজন্ম একে একে ইন্টারনেট, মোবাইল ও সোস্যাল মিডিয়ার কারণে আজ টেলিগ্রাফ, ট্রাঙ্কল, পোস্ট অফিস প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিপাদ্য বিষয় থেকে একেবারেই দূরে সরে এসেছে; একই ভাবে তারা জয়েন্ট ফ্যামিলির নিগূঢ় আত্মাঘনবোধ থেকেও ক্রমশ যোজন যোজন দূরত্বে এসে দাঁড়াবে। সময়ের তাগিদে নাগরিক জীবন থেকে মুছে যাবে একান্নবর্তী পরিবারের হৃদয়জ আবেদনটুকু। শুধু পড়ে থাকবে টুটাফাটা অন্তরের টান।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: