ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কখনও অসুস্থ হলে দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেব

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কখনও অসুস্থ হলে দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেব

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সত্যিই এক ব্যতিক্রমী চিত্র! হাসপাতালের কাউন্টারের রোগীদের কাছে টিকেট বিক্রি ও রেজিস্ট্রেশনকারী কর্মকর্তার ভিমড়ি খাওয়ার দশা। কাউন্টারের সামনে রোগীদের লাইনে দাঁড়ানোর নির্ধারিত স্থানে আর কেউ নন, এ যে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাঁড়িয়ে। প্রধানমন্ত্রী কাউন্টারে গিয়ে হাসিমুখে নিজ হাতে বাড়িয়ে দিলেন রেজিস্ট্রেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্ধারিত ফিস। হতবাক ও বিস্ফোরিত চোখে কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্ধারিত ফিস নিয়ে তার হাতে তুলে দিলেন চেকআপের রশিদ। আর সেই রশিদ নিয়েই গাজীপুরে তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত হাসপাতালে নিজের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখানেই শেষ নয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য করে সাফ জানিয়ে দিলেন অসুস্থ হলে বিদেশে নয়, এখন থেকে দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেবেন তিনি। আবেগাক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী সবার উদ্দেশে বলেন, “আমি যদি কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ি, আপনারা আমাকে বিদেশে নেবেন না। এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে উঠাবেন না। আমি দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেব। এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নেব।” গাজীপুরের কাশিমপুর তেতুইবাড়ির শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মেমোরিয়াল হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর সময় এই আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শুক্রবার সকাল ৮টায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গণভবন থেকে বের হয়ে যান গাজীপুরে তার মায়ের নামে গড়েতোলা বিশেষায়িত এ হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌঁছেই সবাইকে হতবাক করে কাউন্টারে গিয়ে স্বাস্থ্য চেকআপের জন্য নিজের নাম রেজিস্ট্রেশন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় নিজ হাতে রেজিস্ট্রেশন ও চেকআপের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করেন তিনি। এরপর হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য চেকআপ শুরু হয়। স্বাস্থ্য চেকআপ শেষে হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও উপস্থিত সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও আগেই আমার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে এখানে আসার ইচ্ছা ছিল। আমরা চিন্তা করেছি, ভবিষ্যতে এইখানে আমরা একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করব। যেহেতু দেশে জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের প্রয়োজন আরও রয়েছে। এছাড়া এখানে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানের নার্সিং ইনস্টিটিউট। কী করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা আরও বেশি করে নিশ্চিত করা যায় সেই চিন্তা থেকে আমাদের এই উদ্যোগ। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ শ্রমিক। এখানে সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের চিকিৎসাকষ্ট লাঘব করা এবং চিকিৎসাসেবা দেয়া আমাদের কর্তব্য। এছাড়া এই এলাকায় উন্নতমানের হাসপাতালের সংখ্যাও কম। সেই চিন্তা থেকেই এখানে এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেই। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেহেতু এখানকার বেশিরভাগ রোগী আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাই তাদের আর্থিকভাবে সুবিধাও দিতে হবে। এক্ষেতে তিনি ডাক্তারদের কনসালট্যান্সি ফি কমানোরও পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালের ফান্ডে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আরও ১০ কোটি টাকা অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, যেহেতু হাসপাতালটি আমাদের মায়ের নামে, তাই এখানে আমাদের পরিবারের সবাই অনুদান দেবে। আপনাদের এবং হাসপাতালের যে কোন সমস্যা আমাদের নিয়মিত জানাবেন। ডাক্তারদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, এখানে উপস্থিত সবাই দেশের স্বনামধন্য ডাক্তার। এছাড়া দেশের অনেক ভাল ডাক্তার ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন। আমরা তাদের এখানে যুক্ত করতে পারি। যদি কোন ডাক্তার এখানে এসে চিকিৎসাসেবা দিতে আগ্রহী হন, তারা প্রতিদিন এখানে আসতে পারেন। এভাবেই আমরা এ হাসপাতালকে আরও উন্নত করে তুলতে পারব। আমি বলতে চাই, জনগণের সেবা করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময় চিন্তা করলাম, আমার একার পক্ষে এটি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই মালয়েশিয়ার খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান কেপিজে- কে যুক্ত করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী, শেখ রেহানা ও আমি এটি উদ্বোধন করি। এখান থেকে আমরা কোন লাভ নিতে চাই না। ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য আরও যে ১০ কোটি টাকার ফান্ড দেয়া হবে সেখান থেকে যে টাকা আসবে তা দিয়ে গরিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রি ট্রিটমেন্ট দেয়া হবে। ইতোমধ্যে এখানে শতকরা ৩০ ভাগ গরিব রোগী ফ্রি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট কমিটিকে নিয়মিত সভা করে চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত কীভাবে করা যায় তার পরামর্শ দেন। তিনি হাসপাতালে ফার্মেসির জন্য নির্ধারিত জায়গায় সুপরিসর ও অত্যাধুনিক ফার্মেসি চালু করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ঢাকায় ট্রাস্টের যে অফিস রয়েছে সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে এই হাসপাতালে রোগী আনার বিষয়টি সমন্বয় করা যেতে পারে। এছাড়া ফুলটাইম ডাক্তারের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি, অধ্যাপক ডাঃ হাবিব এ মিল্লাত এমপি, ডাঃ এনামুর রহমান এমপি, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ দীন মোঃ নুরুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান, হাসপাতালটির সিইও জয়তুন সোলায়মান ও পরিচালক আরিফ মাহমুদ, হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সদস্য বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত ফিস জমা দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য চেক-আপ করেন নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ দীন মোঃ নুরুল হক ও অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। এছাড়াও স্বাস্থ্য চেকআপে আরও অংশ নেন ডাঃ ওয়াজিহা আক্তার জাহান, ডাঃ বনজবা ও ডাঃ শাহানা ফেরদৌস। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৮ নবেম্বর মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান কেপিজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে এ হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। এর নামকরণ হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নামে, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু, চক্ষু, নাক-কান-গলা, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরীক্ষার আধুনিক ব্যবস্থার জন্য এ হাসপাতাল ইতোমধ্যে প্রশংসা অর্জন করেছে।
×