ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

কোন ছাড় নয়

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

কোন ছাড় নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রভাবশালীদের যতই চাপ আসুক না কেন, কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিতে পুলিশবাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কারও অন্যায় আবদার প্রশ্রয় দিবেন না। অন্যায়কারী কোন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি হলেও তাকে ছাড় দেয়া যাবে না। দলীয় পরিচয়ে কেউ অন্যায় করলে এমনকি আমার দলেরও কেউ যদি এক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে চায়, সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। আমার সঙ্গে যোগাযোগের সব সুযোগ কিন্তু আছে। সব সময়ই এ যোগাযোগটা আমরা রাখি। কিছু প্রভাবশালী লোক থাকে, নানা রাজনৈতিক পরিচয়ে তারা সেই প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। তাই আমার নির্দেশ থাকবে- প্রভাবশালী, দখলবাজ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী আওয়ামী লীগের হলেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হোন। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬ উপলক্ষে জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ভাষণ প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলার পাশাপাশি চোরাচালান ও নারী-শিশু পাচার যেন বন্ধ হয়- সেজন্য সতর্ক থাকতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা মোকাবেলার ক্ষেত্রে পুলিশবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বোমা হামলা মামলার তদন্তেও পুলিশ পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশবাহিনী আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে পারছে বলেই বর্তমান সরকার দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারছে। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. এম মোজাম্মেল হক, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এম শহীদুল হক, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেছুর রহমান, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ইকবাল বাহার, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান, নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার আমেনা বেগম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন সমস্যা ও দাবির কথা তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পুলিশ বিভাগ গঠন, থানা ও আলামত সংগ্রহের স্থান বৃদ্ধি, পুলিশের আবাসন সমস্যা নিরসন, থানাপ্রতি ৫টি পিকআপভ্যান, রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উন্নীতকরণ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পুলিশের একজন লিয়াজোঁ কর্মকর্তা নিয়োগ এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, দুদক, পাসপোর্ট অফিস, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ, কারা অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান। এছাড়া পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তত আরও ১০টি গ্রেড-১ পদ সৃষ্টি। বর্তমানে পুলিশের আইজির পদ ছাড়াও আরও ২টি গ্রেড-১ পদ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সন্ত্রাসবাদ দমনে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে ‘কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট’ গঠনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, অপরাধের ধরন বদলাচ্ছে। এজন্য কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গঠন করে বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এ্যাডভাইজারি কমিটির’ সক্রিয়তার বিষয় উল্লেখ করে বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ যেন কোনমতেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকা- স্বাচ্ছন্দ্যে পরিচালনায় তার সরকারের কয়েকজন সচিব নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের কর্মকা- বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলা পুলিশপ্রধানকে ভূমি দখলকারী বিশেষ করে গরিবের সামান্য সম্পত্তি ও ছিনতাইকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, দুর্বলদের সুরক্ষা করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনারা দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সকল সঙ্কট কাটিয়ে আমরা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিচ্ছি। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন এবং নিরাপত্তার সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণ গড়তে আপনারা দেশের উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেনÑ এ আমার প্রত্যাশা। সর্বোচ্চ দেশপ্রেম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে পুলিশবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণে আবদ্ধ এই লাল-সবুজের পতাকা। এই দেশ ও জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে আপনাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। জনগণের সেবক হয়ে কাজ করতে হবে। দেশব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে আরও সক্রিয় এবং কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন বড় সমস্যা হচ্ছে মাদক। যুবসমাজে মাদকের বিস্তার ঘটছে। সমাজের উঁচু থেকে নিচ- সর্বত্র এখন মাদকের বিস্তার। অনেক পরিবার মাদকাসক্তির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিমানবন্দরের যথাযথ নিরাপত্তা জোরদার ও নিশ্চিত করতে কম্পোজিট ফোর্স গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিমানবন্দরগুলোর দৃশ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সমন্বয়ে ’কম্পোজিট ফোর্স’ গঠন করা হবে। বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে এটি গঠিত হবে। এতে পদ-পদবী নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগলে চলবে না। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের কার্যকর নিরাপত্তা বৃদ্ধি নিশ্চিত না হলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যেও ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কম্পোজিট ইউনিটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান ও চাহিদা অনুযায়ী অতিদ্রুত বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন তিনি। সড়ক, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়কগুলো নিরাপদ করার বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ নজর দিতেও বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সফলতা তুলে ধরে বলেন, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এখন বিদেশে চাল রফতানি করছি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৪ হাজার ৭৭ মেগাওয়াট হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যাও ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। দেশের জিডিপির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করার পেছনে পুলিশ বাহিনীরও অবদান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত তা-ব না চালালে দেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করা যেত। তবে এবার আমরা প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জন করব ইনশা আল্লাহ। পুলিশবাহিনীর উন্নয়নে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আমরা আবার পুলিশের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করি। পুলিশের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, ঝুঁকি ভাতার প্রচলন, কল্যাণ ফান্ড গঠন, নতুন নতুন থানা ও ব্যারাক নির্মাণ এবং পুলিশের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন সংগ্রহ করা হয়। বর্তমান মেয়াদে থানাগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল এবং বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা পদায়ন করা হচ্ছে। পুলিশের আবাসন ও অফিসের স্থান সঙ্কট নিরসনে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নতুন বিভাগগুলোতে আবাসন সমস্যা সমাধানে পুলিশের জন্য জমি বরাদ্দের ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের এসব কার্যকর পদক্ষেপের ফলে পুলিশবাহিনীর আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। পুলিশের ডিভিশন এবং ব্যাংক সৃষ্টির জন্য তাদের দাবি লিখিত প্রস্তাব আকারে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পুলিশকে জনগণের সেবক হতে হবে এবং তাদের অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো দাঁড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের সেবা, কল্যাণ, মঙ্গল- এটাই কিন্তু একমাত্র লক্ষ্য। আর সেটা করতে গেলে যেটা সব থেকে প্রয়োজন তা হলো আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা। আর সে দায়িত্বটা সার্বিকভাবে পুলিশের ওপরই বর্তায়। কাজেই পুলিশবাহিনীকে আমরা সেভাবেই তৈরি করে দিতে চাচ্ছি, যেন তারা তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করতে পারে। তিনি বলেন, নিজেদের কাজ সম্পর্কে পুলিশের সচেতনতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশে যে একসময় জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। আর অর্থনৈতিক অগ্রগতিও আমরা অব্যাহত রাখতে পারছি। ২০১৫ সালে সরকার উৎখাতের নামে তিন মাস যে তা-ব চলে, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের অগ্রণী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান তিনি। ওই সময় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন শেখ হাসিনা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, সড়ক, মহাসড়ক, রেলওয়ে ও পর্যটনের নিরাপত্তার বিষয়েও নজর দেয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস সৃষ্টির বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশবাহিনীর সদস্যদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সকলের বেতন বলতে গেলে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করেছি। পৃথিবীর কোন দেশে আজ পর্যন্ত কোন সরকার শতভাগের ওপর বেতন বৃদ্ধি করতে পারেনি। আমরা কিন্তু তা করে দিয়েছি। আমরা চাই সবার জীবনযাত্রা সহজ ও সুন্দর হোক।
×