ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

তেল নিয়ে তেলেসমাতি কা-কারখানা শুরু হয়েছে সারা বিশ্বে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল। ভোজ্যতেল নিয়েও হচ্ছে, তবে এটি দেশে। আর সারা বিশ্বে হচ্ছে জ্বালানি তেল- পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল ইত্যাদি নিয়ে। যারা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিখ্যাত ‘তৈল’ নিবন্ধটি স্মরণ করতে পারবেন, তাদের জন্য বর্তমান বিষয়টি যৎকিঞ্চিৎ সরস বলেও বিবেচিত হতে পারে। সত্যি বলতে কি, বর্তমান বিশ্ব চলছেই অনেকটা তৈলমর্দন, তৈলবর্ধন, তৈলচিক্কণ, তৈলনিক্বণ ইত্যাদির ওপর। আরবী তেলেসমাত বা তেলেছমাত শব্দটির বাংলার্থ জাদু বা আশ্চর্য ঘটনা। সে থেকে তেলেসমাতি বা তেলেছমাতি। অর্থ ঐন্দ্রজালিক বা জাদু সম্বন্ধীয়। আসলেই তেল নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে সারা পৃথিবীতে যা ঘটে চলেছে, তা যেন হার মানাতে চাচ্ছে ঐন্দ্রজালিক কোন জাদুকেও। একেবারে হু হু করে কমছে তেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে ১৮ জানুয়ারি সোমবার জ্বালানি তেলের প্রধান ব্র্যান্ড ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ২৮ ডলার ১৭ সেন্ট। অন্যদিকে ইউএস ক্রুড অয়েলের দাম, যা প্রধানত শেল অয়েল নামে পরিচিত, দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ২৮ ডলার ৮৬ সেন্ট। ২০০৩ সালের পরে গত ১৩ বছরে জ্বালানি তেলের দাম কখনোই এত নিচে নামেনি। বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল ১০০ ডলারের বেশি, ১২০ ডলারের কাছাকাছি। সেখান থেকে মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তেলের দাম এত নিচে নেমে আসার কারণ কি? এর সহজ উত্তর হলো, চাহিদার তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত সরবরাহ। ওপেকভুক্ত ১২টি দেশ প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করছে। এর সঙ্গে গত বছর অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে জমা হয়েছে ৩০০ কোটি ব্যারেল তেল। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে মার্কিন শেল ওয়েল, যার উত্তোলন খরচ আগে অনেক বেশি হলেও এখন কমে এসেছে অনেক। ফলে মার্কিনীরাও এখন তেল ছেড়ে দিচ্ছে কম দামে। অন্যদিকে রাশিয়াও তার মজুদ তেল বিক্রি করে দিচ্ছে। সৌদি আরব তার তেলের উৎপাদন ও যোগান কমাবে না বলেছে। আর এতে সর্বশেষ যোগ দিয়েছে ইরান। মার্কিন অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়ায় ইরানও প্রবেশ করতে চাইছে আন্তর্জাতিক বাজারে। ইরান বলছে, তারা এখনই দৈনিক ৫ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি করতে প্রস্তুত। তেল বিশেষজ্ঞ ও বাজার গবেষকরা বলছেন, আগামী এক বছর অন্তত বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ২৫ থেকে ৪০ ডলারে ওঠানামা করবে। হংকংয়ের এশিয়া ফিন্যান্সিয়াল ফোরাম সূত্রে জানা যায়, তেল উত্তোলন ও বাজারজাতকারী দেশগুলো বর্তমানে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করছে, যা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কতদিন? তেল-রাজনীতি (অয়েলো-পলিটিক্স) বা তেল-অর্থনীতি (অয়েলোনিমিক্স), যা-ই বলি না কেন, অন্তত আগামী দু’চার বছর নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। এখানে সাধারণ পাঠকের সুবিধার্থে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল, শেল অয়েল ও ব্যারেলের মাপটা একটু বলি। ওপেকভুক্ত দেশগুলো প্রধানত উৎপাদন করে থাকে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল, তুলনামূলকভাবে যার মান ভাল এবং উত্তোলন খরচও কম। অন্যদিকে গভীর শিলাস্তর থেকে ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে আহরিত শেল অয়েলের উত্তোলন খরচ বেশি এবং পরিশোধন ব্যয়ও কিছু বেশি পড়ে। প্রযুক্তি ও কারিগরি ব্যাখ্যা যা-ই থাকুক না কেন, বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের চাহিদা শেল অয়েলের তুলনায় সর্বদাই বেশি। অন্যদিকে এক ব্যারেল হলো ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড পরিমাপ অনুযায়ী ৩৪ দশমিক ৯৭ গ্যালন অথবা ১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার। পাঠক এখন মনে মনে হিসাব করে দেখুন, বিশ্ববাজারে গত কয়েক মাসে তেলের দাম কতটা কমেছে? আমজনতার জন্য এর তাৎক্ষণিক সুফল কী হওয়া উচিত? মোটা দাগে বলা যায়, জ্বালানি তেলের দাম কমায় সার্বিকভাবে উৎপাদন, সরবরাহ, পরিবহন, যাতায়াত ও বিপণন খরচ কমে আসার দরুন ভোগ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম খুব দ্রুতই নেমে আসার কথা। অন্তত অর্থনীতির নিয়ম ও সূত্র তো তা-ই বলে। তবে সাধারণ মানুষ কি তার সুফল পাচ্ছে আদৌ? দেশ ও বিশ্বব্যাপী? উত্তর হলো, পাচ্ছে না। সবাই জানেন, গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব পরিস্থিতি অনেকটাই মন্দাবস্থার ভেতর দিয়ে গেছে। দেশে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা লেগেই আছে। অধিকাংশ দেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধি হোঁচট খেয়েছে, গড়ে ২-৩ শতাংশ। কোন কোন দেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। ফলে জিনিসপত্রের দাম ও বেকারত্ব বেড়েছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করেই যেন ধস নেমেছে তেলের বিশ্ববাজারে। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব কি রকম পড়বে, প্রবৃদ্ধি হবে ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক, তা বিশ্লেষণ ও নির্ণয়ে নেমে পড়েছেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তকরা। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন, ব্রাজিলের পাশাপাশি উন্নত ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক দিন ধরেই হ্রাস পাচ্ছে অথবা শ্লথগতিসম্পন্ন। এই দেশগুলো কি তেলের মূল্য হ্রাসের সুফল কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? অথবা ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া! এর উত্তরের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, তেলের দাম নিয়ে কোন ভবিষ্যদ্বাণী আপাতত খাটছে না। বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার কথা গত কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় তা আরও উস্কে দিচ্ছে চলমান সঙ্কটকে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর এখন ত্রাহি অবস্থা। তেলের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম কমে আসায় অনেক দেশই পড়েছে সঙ্কটে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ যেমন ব্রাজিল, চীন এবং ইউরোপের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ধস নেমেছে শেয়ারবাজারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনে শেয়ারবাজার তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও স্টিলের বড় রফতানিকারক রাশিয়ার শেয়ারবাজারেও ঘটেছে ব্যাপক দরপতন। তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে ওপেক আগে প্রভাব বিস্তার করলেও বর্তমানে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে চরম উত্তেজনা তথা বৈরী ভাব বজায় থাকায় এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে ওপেককে। সর্বশেষ গোল্ডম্যান স্যাকস জানিয়েছে, অচিরেই তেলের দাম নেমে যেতে পারে ২০ ডলারে। তাহলে তেলের আর থাকল কী! কী হচ্ছে বাংলাদেশে? অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম শনৈঃশনৈঃ কমে যাওয়ার আদৌ কোন সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশের জনগণ। এর পাশাপাশি এটাও সত্য যে, বিশ্ববাজারে যখন তেলের দামে প্রচ- উল্লম্ফন দেখা দিয়েছিল, তখন সরকার প্রচুর ভর্তুকি বা সাবসিডি দিয়ে উৎপাদন ও জনজীবন সচল রাখতে সহায়তা করেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দাবস্থার প্রায় কোন উত্তাপ লাগেনি বাংলাদেশে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধিও ৬.৩ থেকে ৬.৭-এর মধ্যে বহমান থেকেছে। বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও কিছুদিন আগে এদেশ সফরে এসে এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তবে ওয়াশিংটন ডিসিতে স্ব-কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের যে দাম কমছে, তার সুযোগ নিতে এবং সদ্ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। তাহলে এসব দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে আগামীতে। কৌশিক বসু এও বলেছেন, ওপেকভুক্ত দেশগুলোর জন্য তেলের দাম কমা অশনি সঙ্কেত হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা সুফল বয়ে আনতে পারে! তাতে করে আগামীতে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়াও খুবই সম্ভব। সরকারের মধ্যে এই মুহূর্তে তেলের দাম কমানো নিয়ে এক ধরনের দোলাচল আছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তেলের দাম কমানোর জোরালো দাবি তুলেছে। অন্যদিকে সরকার বলছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসির অতীতের দায়দেনা, ভর্তুকি, ঘাটতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠলেই তেলের দাম কমানোর চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি পলায়নী মনোবৃত্তি। অন্যদিকে সরকার তথা বিপিসির তেলনীতির কারণেও সরকার অন্তত এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক কম দামে তেল কিনতে পারছে না। বিপিসি সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) দীর্ঘমেয়াদী অন্তত দু’বছরের চুক্তির আওতায় তেল কিনে থাকে শুধু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। সেক্ষেত্রে ওই দেশের সরকার নির্ধারিত দামই হয় বিপিসির তেলের দাম। বিপিসি সর্বশেষ ২৮ নবেম্বর আবুধাবি থেকে অপরিশোধিত তেল কিনেছে ৪৩ দশমিক ৫৫ ডলারে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত যুক্ত হয় প্রিমিয়াম, পরিবহন (জাহাজ ভাড়া), পরিশোধন ব্যয়, বিপণন ইত্যাদি। এত সবের পরও গড় হিসাবে দেখা যায় বিপিসি প্রতি লিটার অকটেনে ৪০ টাকা, পেট্রোলে ৩৫ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিনে ২০ টাকা এং ফার্নেস অয়েলে ২৫ টাকা কম-বেশি লাভ করে থাকে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় বিপিসি ইতোমধ্যে যে বিপুল মুনাফা করেছে, তা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনা পরিশোধ করেছে। এখন নাকি অর্থ মন্ত্রণালয় অতীতের ভর্তুকি বাবদ প্রদত্ত ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ফেরত চাইছে। এ টাকা ফেরত দিতে হলে বিপিসিকে তেলের দাম আরও অন্তত চার বছর বর্তমান পর্যায়ে রাখতে হবে। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে তেলের দাম কমানো নিয়ে একটি বোঝাপড়া তথা সমঝোতায় আসতে হবে সরকার ও বিপিসিকে। তবে আমাদের বক্তব্য, অতীতের ভর্তুকির দায় জনগণের ঘাড়ে বর্তাবে কেন? তদুপরি বিপিসির দুর্নীতি-অনিয়মও তো কারও অজানা নয়। সেসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি যত কম করা যায়, ততই মঙ্গল। সব মানুষ চায় তেলের দাম কমার আশু সুফল পেতে। দেশে এই মুহূর্তে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও আছে। অথচ বাস্তবতা হলো, যত বেশি জ্বালানি, তত বেশি বিদ্যুত, তত বেশি বিনিয়োগ তথা শিল্পায়ন, তত বেশি কর্মসংস্থান, বেকারত্বের অবসান, উৎপাদন উন্নয়ন, সর্বোপরি জাতীয় প্রবৃদ্ধি। দেশের জন্য বর্তমানে এটাই সর্বাধিক কাক্সিক্ষত চাওয়া-পাওয়া। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী দু’বছরের মধ্যে ঘরে ঘরে, অন্তত ৯০ শতাংশ ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেবে। তবে সেটা এই মুহূর্তে নয় কেন? বর্তমানে ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। বিশ্ববাজার থেকে বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক কম দামে তেল কিনে সেটা এই মুহূর্তে আরও বাড়ানো যায় কি-না, বিশেষ করে শিল্পোৎপাদনের জন্য! সেক্ষেত্রে সরকার খোলাবাজার থেকে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে তেল কিনতে পারে। এর জন্য সরকারী ক্রয় নীতি পরিবর্তন করতে হতে পারে। সরকার চাইলে এটি বেসরকারী খাতের জন্যও উন্মুক্ত করে দিতে পারে। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি বেশ ভাল। সরকার চাইলে এমনকি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেও (পিপিপি) জ্বালানি তেল আমদানি, বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। মোটকথা, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার যতটা সুফল ঘরে তোলা যায়, মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে হলেও সরকার ও বেসরকারী খাত যেন তা তুলতে সমর্থ ও সক্ষম হয়। তেল কূটনীতি বা অয়েল ডিপ্লোমেসির সাফল্য ও সার্থকতা নিহিত রয়েছে সেখানেই। সর্বশেষ, সরকার চাপে পড়ে তেলের দাম যৌক্তিক করার উদ্যোগ নিলেও তা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বিত ও সমান্তরাল হবে না বলে জানা গেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অগ্রগতি, উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্বালানি। বর্তমানে যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত উন্নতির পথে ধাবমান, সেহেতু তেল-গ্যাসের মতো জ্বালানির চাহিদাও ক্রমবর্ধমান। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে তেল কিনতে পারে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। তবে সরকার টু সরকার চুক্তির ভিত্তিতে বিপিসি তেল আমদানি করে থাকে বিধায় তাদের সুযোগ সীমিত। এক্ষেত্রে বরং বেসরকারী খাত উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। সরকার সেটা কতটা করবে, তা এই মুহূর্তে জানা না গেলেও, সম্প্রতি ১৩টি বেসরকারী বিদ্যুত কেন্দ্রকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। দেশে বেসরকারী খাতকে আরও উজ্জীবিত ও উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এটি একটি সুসংবাদ নিঃসন্দেহে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে বেসরকারী খাতে তেল আমদানির যৌক্তিকতা আরও বেড়ে গেল বৈকি। এক হিসাবে দেখা যায়, বেসরকারী খাতের আমদানিকৃত তেল দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৭-৮ টাকা। অন্যদিকে বিপিসির কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামে তেল কিনে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম পড়ে ১৪-১৬ টাকা। সরকারের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দামের সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধান না করাই এর মূল কারণ। সে ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতকে সব রকম জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ দিলে সার্বিকভাবে উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে গতি তথা প্রাণসঞ্চার হবে বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা উন্নয়নের মূল কথা হলো, যত বেশি জ্বালানি, তত বেশি বিদ্যুত, তত বেশি উন্নয়ন। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সূত্র মতে, বর্তমানে ডিজেল ও ফার্নেস তেলে পরিচালিত হচ্ছে ৪১টি বিদ্যুত কেন্দ্র। এর মধ্যে ১০টি ডিজেল, ৩১টি ফার্নেস অয়েল। ৪১টির মধ্যে ১৬টি পিডিবি পরিচালিত। বাকি ২০টি বেসরকারী। এর মধ্যে ১৩টি অনুমতি পেয়েছে জ্বালানি তেল আমদানির। আবেদনের প্রেক্ষিতে বাকিগুলোকেও তেল আমদানির অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে দেখভাল করতে হবে অবশ্যই।
×