ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দক্ষতা ও স্বৈরাচার -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫

দক্ষতা ও স্বৈরাচার  -স্বদেশ রায়

বাঙালী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজের হাত ধরে। এর ধারাবাহিকতা ইংরেজ চলে যাবার পরে খুব বেশি দিন রক্ষা করতে পারেনি। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার মান নেমে চলেছে। শিক্ষার এই মান নামার কারণে সবক্ষেত্রে দক্ষতা কমে আসছে। এ মহূর্তে রাষ্ট্রে বা সমাজে সবখানে যে দক্ষতার অভাব, মানুষের চিন্তা ও চেতনায় যে মৌলিকতার অভাব এর অন্যতম একটি কারণ শিক্ষার মান ধরে না রাখা। শিক্ষার মান কখনই কিন্তু শুধু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে না। এ প্রতিষ্ঠানগুলো একটা বড় ভূমিকা রাখে শিক্ষার মান বাড়াতে, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে, মানুষকে মৌলিক ভাবনার পথে নিয়ে যেতে। বাস্তবে একটি মানবগোষ্ঠীর শিক্ষিত বা দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজকে সার্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। যেমন ইংরেজ আমলে বাঙালী যখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে একটি জ্ঞাননির্ভর দক্ষ জনগোষ্ঠী হবার পথে এগুতে থাকে, এ সময়ে কিন্তু শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, সার্বিক রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবেশ তাকে সাহায্য করেছিল। এ দেশটি ইংরেজের কলোনি ছিল, তারা স্বৈরাচারী পথে রাষ্ট্র পরিচালিত করত কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা কিছু বিষয়ের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করেছিল। প্রথমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইংরেজ আমলে যতখানি মানুষ ভোগ করতে পেরেছে তা আর কখনও পারেনি। নজরুল লেখার কারণে যেমন জেল খেটেছেন, তেমনি নজরুল তখন যা লিখেছেন তা আজকের বাংলাদেশে বা ভারতে বসে লেখা সম্ভব নয়। সেই মতপ্রকাশের নিশ্চয়তা কিন্তু ইংরেজ চলে যাবার পরে এই ভূখণ্ডগুলো আর দিতে পারেনি। তার বদলে মতপ্রকাশের ওপর আসছে মূর্খদের নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষিতরা কী মতপ্রকাশ করবে তা এখন এই উপমহাদেশের প্রতিটি ভূখ-ে নিয়ন্ত্রণ করছে মূর্খরা। কোথাও কম, কোথাও বা বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। আর দক্ষতার দিক থেকে সব থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কেন এই যোগ্যতা ও দক্ষতার দিক থেকে এতটা পিছিয়ে পড়ল তা এখনই সমাজের দায়িত্ববান ও যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা উচিত। তবে একজন স্বল্পশিক্ষিত সাংবাদিক হিসেবে সাধারণ সাদা চোখে বা রিপোর্টারের চোখে যা দেখতে পাই তার ভেতর দিয়ে কতকগুলো বিষয় সামনে আসে। যেমন সমাজ থেকে ভাষা শিক্ষা কমে গেছে। যার ফলে সার্বিক জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। ইংরেজ আমলে মধ্যবিত্ত বাঙালী হিন্দু পরিবারে কমপক্ষে চারটি কখনও পাঁচটি ভাষা শিক্ষার স্বাভাবিক চল ছিল। বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সী ও ইংরেজী এই চারটি ভাষা প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে কম-বেশি সকলে জানতেন। কেউ কেউ উর্দুও জানতেন। ঠিক তেমনিভাবে বাঙালী মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারগুলো, বাংলা, আরবী, উর্দু ও পরবর্তীতে ইংরেজী জানতেন। এছাড়া ফার্সীও তারা জানতেন। অর্থাৎ পাঁচটি ভাষা তখন শিক্ষিত বাঙালী পরিবারের একটি অংশ জানতেন। আর এই পাঁচ ভাষার সাহিত্য বা সব ধরনের জ্ঞান বিজ্ঞানের বই তখন যাতে বাজারে থাকে ইংরেজ শাসকরা সে ব্যবস্থা কিন্তু করত। এর পাশাপাশি গ্রীক, ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ চর্চাও তখন বাঙালী সমাজে ছিল। তাই তখন স্বাভাবিকই জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সহজ সুযোগ ছিল। আর এই সহজ সত্যটি সকলেই জানেন, একমাত্র জ্ঞানই মানুষকে দক্ষ করে। জ্ঞানচর্চা ছাড়া দক্ষ হওয়ার অন্য কোন বিকল্প নেই। পাকিস্তান আমল থেকে এ সমাজে এই ভাষা শিক্ষাকে কেটে ফেলা হয়েছে। কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত হাজার বছরের সিভিলাইজেশনের যে বিশাল জ্ঞানভা-ার সংস্কৃত ভাষা মাধ্যমে আছে, এই ভাষাকে মৃত ভাষা মনে করে কেন শিক্ষা থেকে কেটে ফেলা হলো তার কোন উত্তর কিন্তু পাওয়া যায় না। উর্দুর মতো একটি ভূমি থেকে জাত বিশাল সাহিত্য সম্ভারে সমৃদ্ধ ভাষাকে কেন শুধু ব্যারাক ল্যাঙ্গুয়েজ বলে সমাজ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হলো তারও কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বোপরি স্বাধীনতার পরে মাতৃভাষাকে সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রে এমন পথে হাঁটা হলো যেন অন্য ভাষাকে ছুড়ে ফেলাই মূলত মাতৃভাষাকে সম্মান দেয়া। কেন যেন ভেবে দেখা হয়নি, সকল মানব প্রজাতি মিলিতভাবে যেমন একটি একক সম্পদ, তেমনি সকল ভাষা মিলিতভাবে একক সম্পদ। যাহোক, শুধু মাতৃভাষানির্ভর হয়ে পড়াতে ছোট হয়ে এলো দেশের মানুষের পৃথিবী। পাশাপাশি সমাজের অন্য ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলা হতে থাকে জ্ঞানচর্চার স্বাভাবিক পরিবেশগুলো। যেমন ধীরে ধীরে দেশে বিদেশী ভাষার বই দুষ্প্রাপ্য করে ফেলা হয়েছে। সরকারের কারও এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। অথচ এ ঘটনা ঘটছে প্রতিটি সরকারের ভুল নীতির ফলে। বিংশ এমনকি একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষার আরও একটি বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র, তাও সরকারের ভুল নীতির ফলে শুধু শিক্ষার মাধ্যম থেকে চলে যায়নি- ধ্বংস হয়ে গেছে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ ও পারিবারিক পরিবেশেও এতই পরিবর্তন এসেছে শিক্ষিত হয়ে ওঠার চাহিদা কোথায় যেন কমে গেছে। তবে হ্যা, আধুনিক অর্থনীতি ও সমাজের চাহিদার কারণে আধুনিক মেশিন টুলসের পাশাপাশি হিউমান টুলস তৈরি হচ্ছে। যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজন মতো এক্সিকিউটিভ বা প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক হিউম্যান টুলস তৈরি করছে। প্রযুক্তির প্রয়োজনে তৈরি হচ্ছে প্রযুক্তির পেছনের হিউম্যান টুলসটি। সার্বিকভাবে একটি দেশ, রাষ্ট্র বা সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন পড়ে জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা। এই দক্ষরাই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে জ্ঞান ও যোগ্যতা দিয়ে। জ্ঞান ও যোগ্যতার সঙ্গে অযোগ্যতার পার্থক্য কতখানি এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে তা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করে তা কিন্তু ছোটখাটো দু’ একটা উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। যেমন ধর্মের নামে দেশ সৃষ্টি হলেও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবে দেয়া প্রথম ভাষণে রাষ্ট্রধর্মকে প্রশ্রয় দেননি। বরং তিনি এক ধরনের সেক্যুলার পাকিস্তানের কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে গবর্নর হিসেবে তিনি পাঞ্জাবে সেনাবাহিনীর উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ভারত শাসন আইনটা সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের পড়ে নিতে। তারা সেইভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। ঠিক তেমনিভাবে গবর্নর হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে এসে চট্টগ্রামে দেয়া ভাষণে তিনি বুরোক্র্যাটদের বলেন, তাদের দায়িত্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া নয়। অর্থাৎ যে রাজনীতির সৃষ্টি রাষ্ট্র- সেই রাজনীতিকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। গবর্নরের শাসন নয়। কিন্তু তার বদলে ইস্কান্দার মির্জা, আইউব খান এরা পাকিস্তান পরিচালনা করে স্বৈরাচারী কাঠামোর মাধ্যমে। কেন এরা স্বৈরাচারী কাঠামোতে দেশ বা রাষ্ট্র শাসন করল। আপাতদৃষ্টিতে স্বৈরাচারকে খুব ক্ষমতাবান মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে সব থেকে দুর্বল ও অদক্ষ লোকটিই স্বৈরাচার হয়। যোগ্যতা যেহেতু জ্ঞাননির্ভর, তাই তার একটা বিশালত্ব থাকে। তাই তিনি উদারতার সিস্টেম দিয়ে সব কিছু পরিচালনা করতে পারেন। যা কখনই একজন অদক্ষ, অশিক্ষিত ও অযোগ্য লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচাররা যা করে তাহলো তারা সমাজ থেকে, রাষ্ট্র থেকে উদারতা ও জ্ঞানকে বিতাড়িত করার সব যন্ত্র প্রতিস্থাপন করে। যার ফলে স্বৈরাচারের পতনের পরেও রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে কিন্তু স্বৈরাচারী আচরণ ও নীতি বিতাড়িত করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। খুবই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সেই পাকিস্তান আমল থেকে দীর্ঘদিন স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকার ফলেই কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে উদারতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা লোপ পেয়েছে। এমনকি পরিবার থেকেও অনেকাংশে চলে গেছে জ্ঞাননির্ভর পরিবার গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা। যোগ্যতা ও জ্ঞানের বদলে চমক, পাবলিসিটি এগুলোকেই বড় মনে করা হয়। এগুলোই অদক্ষ এবং অযোগ্যদের একমাত্র পন্থা। এ ছাড়া কোন কাজের দ্বারা সমাজ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার তাদের কোন সুযোগ নেই। যেমন বিচারপতি খায়রুল হক যতদিন প্রধান বিচারপতি ছিলেন, কেউ মনে করতে পারবেন না যে সপ্তাহে অন্তত দুবার পত্রিকার পাতায় ছবিসহ তাঁর বক্তৃতার খবর মানুষ দেখেছে। তবে তাঁর নাম পত্রিকায় আসত অর্থাৎ অশিক্ষিত স্বৈরাচার খালেদার মতো নেতারা তাঁর সম্পর্কে যখন বিরূপ মন্তব্য করতেন তখনই। কোনদিন পত্রিকার পাতায় না আসার পরেও, পাড়ায় পাড়ায় বক্তৃতা দিয়ে না বেড়ানোর পরেও ইতিহাসের পাতায় খায়রুল হকের নাম থাকবে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে বাংলাদেশকে স্বৈরাচার সৃষ্ট কালো গহ্বর থেকে বের করে আলোর পথে নিয়ে আসার পথটি তিনিই করে দেন। তাও কোন সুবিধাজনক সময়ে নয়। খালেদার মতো স্বৈরাচারের আমলে। এখানেই কিন্তু প্রমাণ করে তাঁর জ্ঞান ও দক্ষতাই তাঁকে এই সাহসী করেছিল। অথচ তিনি প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়, একজন বিচারপতি কোন জেলায় গেলে ডিসি যেন তাকে যানবাহন না দেন, আবার সম্মানিত কোন বিচারপতি বিদেশে গেলে হাইকমিশন যেন তাকে প্রটোকল না দেন এমন স্বৈরাচারী আদেশ দিয়ে নিজেকে বড় করার মিথ্যে চেষ্টা করতে হয়নি। সম্প্রতি বিচারপতি খায়রুল হক একাত্তর টিভিতে এ প্রজন্মের অন্যতম সাহসী, পরিশ্রমী ও যোগ্য রিপোর্টার ফারজানা রূপাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে সমাজের এই দক্ষতার মান নেমে যাবার বিষয় সম্পর্কে বলেছেন। অত্যন্ত বিনয়ী (জ্ঞানী মাত্রই বিনয়ী হন সমস্ত মূর্খই দুর্বিনীত) এই মানুষটি অন্য পেশার কথা বলেননি। তাঁর নিজের পেশার ভেতর সীমাবদ্ধ থেকেছেন। তিনি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, ষাটের দশকে যে মাপের বিচারপতিরা ছিলেন বর্তমানে তিনি নিজেকেও সে মাপের মনে করতে পারেন না। তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে যা বলেছেন তা সঠিক নয়- তিনি অনেক বড় মাপের বিচারপতি। তবে বাস্তবতা হলো ষাটের দশকের প্রতিক্ষেত্রে যারা ছিলেন সেখান থেকে সব ক্ষেত্রে দেশ ও সমাজ নেমে গেছে। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজের হাত ধরে যে দক্ষতা ও যোগ্যতা সৃষ্টির ধারা তৈরি হয়েছিল তার রেশটি ষাটের দশক অবধি ছিল। এখন ধীরে ধীরে তা একেবারেই নিভে যাচ্ছে। তাই এখনই যদি আলো জ্বালানোর সার্বিক চেষ্টা না হয়, তাহলে কালো অন্ধকার একবার শুধু মতিঝিল শাপলা চত্বরে এসে থেমে যাবে না, গোটা দেশ আলোহীন হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা অনেক কৌশলে দেশকে খুনী মুক্ত করে দেশকে প্রকৃত রাজনীতির পথে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টার প্রকৃত সুফল পেতে হলে রাষ্ট্র ও সমাজকে জ্ঞানভিত্তিক করতেই হবে। জ্ঞানের উদার আলোয় যতক্ষণ না দেশ আলোকিত হবে ততক্ষণ অন্ধকার গেছে এ কথা বলা যাবে না। তবে হতাশা নয়, বাঙালীর সংস্কৃতিতে আলোকে গ্রহণ করার ও আলো জ্বালার যে উপাদান আছে এ অনেক বড় ভরসা। তবে শুরুতে অন্তত একটি শ্রেণীকে রবীন্দ্রনাথের আহ্বান শুনতে হবে- অর্থাৎ আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে পথ দেখতে হবে ও দেখাতে হবে। [email protected]
×