ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দীপন হত্যার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের আধাবেলা হরতাল আজ

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩ নভেম্বর ২০১৫

দীপন হত্যার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের আধাবেলা হরতাল আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে আজ দেশব্যাপী আধাবেলা হরতাল পালন করবে গণজাগরণ মঞ্চ। খুনীদের গ্রেফতাদের দাবিতে মঞ্চের আহ্বানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সোমবার কালোব্যাজ ধারণসহ শোক কর্মসূচী পালিত হয়। হরতাল সফল করতে সন্ধ্যায় প্রজন্ম চত্বরে মশাল মিছিল করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। হামলা ও হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। রাজপথে ফুঁসে ওঠেছেন সর্বস্তরের মানুষ। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল ছিল দিনভর। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায়ী সমিতির ডাকে সারাদেশে বেলা দুইটা পর্যন্ত দোকান বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করা হয়। রাজধানীর বাংলাবাজারে সকালে কালোপতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কর্মসূচী। পরে প্রকাশকরা মুক্তচিন্তার বিভিন্ন গ্রন্থ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পুড়িয়ে দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয় স্বারকলিপি। শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের সকল দোকানের সাইনবোর্ড কালোকাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদে সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে ছাত্র, শিক্ষকসহ বিভিন্ন সংগঠন। এদিকে সিপিবি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন পৃথক পৃথক বিবৃতিতে হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। প্রেসক্লাবের সামনে দিনভর নানা কর্মসূচী ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা, কবি তারেক রহিম, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আমেদুর রশীদ টুটুল ও লেখক রণদীপম বসুর ওপর হামলার প্রতিবাদে ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সংহতি সমাবেশ করছে বিভিন্ন সংগঠন। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ গণপ্রতিরোধ ও সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে মিডিয়া এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, কনকর্ড এ্যাম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্সের প্রকাশকসহ সমমনা বিভিন্ন সংগঠন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব মীর, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসুসহ সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। সমাবেশে বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, একের পর এক হত্যা করে চলেছে। কিন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব। কোথা থেকে কীভাবে হুমকি দিচ্ছে? সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা জানে। অথচ তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। পুস্তক প্রকাশক সমিতির সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, একের পর এক হামলা করে প্রকাশকদের থামিয়ে দিতে চায় উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী। কিন্তু তাদের আশা কোন দিনই পূরণ হওয়ার নয়। যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি আসুক না কেন প্রকাশকরা তাদের অবস্থান থেকে এক পাও পিছু হটবে না। হামলা বা হত্যার মুখে প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখকদের বই প্রকাশ করে যাবে। তিনি অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেন, হত্যাকারীদের সঙ্গে কোন আপোস হতে পারে না। যে কোন মূল্যে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তারা অপশক্তির বিরুদ্ধে। শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সন্ত্রাসীরা। এরপর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। এ দুটি প্রকাশনা সংস্থা থেকেই বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক অভিজিত রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল। যিনি নিজেও গত ফেব্রুয়ারিতে একই কায়দায় হামলায় নিহত হন। শনিবারের হামলার ঘটনার আগে চলতি বছর মোট চারজন ব্লগার-লেখক একইভাবে খুন হলেও পুলিশ কোন মামলারই কিনারা করতে পারেনি। সকালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কালো ব্যাজধারণ করে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। এ সময় প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মীরা অংশ নেন। মঙ্গলবারের হরতাল সফল করতে দেশবাসীর সমর্থন প্রত্যাশা করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেনÑ আপনি যদি মনে করেন, আপনার ওপর হামলা হয়নি বলে ঘরে বসে থাকবেন, প্রতিবাদের দরকার কী? তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আপনার সন্তানকেও যে সিরীয়দের মতো সাগরে ভাসতে হবে না, তার গ্যারান্টি কী? তাই আপনার ভবিষ্যতের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আসুন হরতাল সফল করে সরকারকে জানান দিয়ে দেই যে, আমরা জঙ্গীবাদের কাছে আত্মসমর্পণ নয়। রাজপথে নেমে মোকাবেলা করে বিজয় অর্জন করব। সরকার বর্তমানে মহাজোটের মধ্যে মহাজট পাকিয়ে ফেলেছে, মন্তব্য করে ইমরান এইচ সরকার বলেনÑ আপনাদের জঙ্গীবাদ দমনের জন্য ক্ষমতায় পাঠানো হয়েছিল, জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য নয়। আপনারা জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দিতে দিতে এখন তারা ঘরে ঢুকে, অফিসে ঢুকে মানুষ হত্যা করছে। একের পর এক হত্যাকা- চললেও আপনারা রাস্তায় নেই কেন? সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে। কর্মসূচী সফল করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। ঢাবিতে দিনভর প্রতিবাদ ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার বিচারের দাবিতে সোমবারও উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, কালোব্যাজ ধারণসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। সোমবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে প্রকাশক দীপন হত্যা ও তিন প্রকাশক হত্যা চেষ্টার প্রতিবাদে ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী-লেখক-নাগরিকবৃন্দ’ ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাবির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রকাশক, লেখকসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। সোমবারের মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেনÑ ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান, অধ্যাপক আকতার কামাল, অধ্যাপক জিনাত হুদা, সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ড. ফাহমিদুল হক, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার প্রমুখ। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, প্রধানমন্ত্রী একদিকে যেমন জঙ্গী উগ্রপন্থীদের দমনে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাচ্ছেন তেমনি অন্যদিকে সরকারেরই কেউ কেউ তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আমরা এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছি যাতে জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ দমন করতে পারে আর মুক্তমনাদের রক্ষা করতে পারে। কিন্তু সরকার যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তবে এখনই সময় বিকল্প কিছু ভাবার। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বিচার হয়নি। ২০১৩ সালে দুইজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৫ সালে আরও চারজন হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকা-ের ঘটনায় যারা ধরা পড়ছে তাদের কোন শাস্তি হয় না। এমনকি পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেয় না। তিনি আরও বলেন, হত্যাকা-ের পর সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয় সেগুলো বিবেচনাহীন। আমরা ক্ষব্ধ, হতাশ। কিন্তু আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। এজন্য সবার আগে তরুণদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার বলেন, একে একে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এরা শুধু ব্লগার, লেখক, প্রকাশককেই নয় যারাই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদেরও হত্যা করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একই ঘটনার প্রতিবাদে আজ সকাল ১১টায় প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলায় ঢাবি শিক্ষক সমিতির ব্যানারে মানববন্ধন এবং বেলা ১২টায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী-লেখক-নাগরিকবৃন্দের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলে মানববন্ধন থেকে জানানো হয়। মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। হরতালে সিপিবির সমর্থন ॥ দীপনকে হত্যা এবং প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিমকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গণজাগরণমঞ্চ আহূত আগামীকাল আজকের দেশব্যাপী হরতালে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সোমবার রাজধানীর পল্টনের মুক্তিভবনে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ঢাকার সদস্যদের এক জরুরী সভা থেকে হরতালে সমর্থন দেয়া হয়েছে। সভায় সেলিম দেশবাসীকে আগামীকালের হরতাল সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে হবে। মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে হবে। সংগঠিত হয়ে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা জনগণকেই করতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য পাড়া-মহল্লা, শিল্প-কারখানা, স্কুল-কলেজ সর্বত্র ‘আত্মরক্ষা ব্রিগেড’ গড়ে তুলতে হবে। যুব ইউনিয়নের সমর্থন ॥ গণজাগরণমঞ্চ আহূত হরতালের প্রতি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আদনান রিয়াদ এক বিবৃতিতে, হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, জনগণের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার এসব ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একটি হত্যাকা-ও রুখতে পারে নাই। ‘গণজাগরণমঞ্চের হরতাল সফল করুন’ ॥ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি এ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ, কার্যকরি সভাপতি সাদেকুর রহমান শামীম ও সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন এক বিবৃতিতে গণজাগরমঞ্চ আহুত অর্ধদিবস হরতালকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি ॥ ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার বিচারে ব্যর্থ হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। এছাড়া সিলেট, নেত্রকোনা, খুলনা, ময়মনসিংহ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা, নরসিংদী, নাটোর, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজবাড়ি, বরগুনা, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলায় প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্বারকলিপিসহ নানা কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
×