ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরোয়ার কর্মচারীকে নৃশংসভাবে হত্যার রোমহর্ষক কাহিনী

রিয়াদের কাকুতি মিনতিতে মন গলেনি পাষণ্ড হোটেল মালিকের

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

রিয়াদের কাকুতি মিনতিতে মন গলেনি পাষণ্ড হোটেল মালিকের

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খুলনায় শিশু রাকিব ও সিলেটে রাজনের পর এবার খোদ রাজধানীতেই মাত্র দেড় হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে কিশোর হোটেল কর্মচারী রিয়াদকে নির্মম নির্যাতনের পর মুখে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা আবারও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হত্যার আগে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির দ্বিতীয় তলায় খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয় রিয়াদকে। এরপর তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। পিটিয়ে পুরো শরীরে জখম করা হয়। শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। রিয়াদের গগনবিদারী আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আসছিল। এরপর মুখে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি চালালে বুলেটটি ভেতর দিকে ঢুকে ঘাড়ের ভেতরের অংশে আটকে যায়। মুখের রক্তনালীগুলো ছিঁড়ে যাওয়ায় গল গল করে রক্ত পড়ে পুরো ফ্লোর রক্তে ভিজে যায়। খুঁটির সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় রিয়াদের নিথর দেহ পড়ে থাকে। হত্যার আগে জীবন ভিক্ষা চেয়ে বহু কাকুতি মিনতি করেছিল রিয়াদ। কিন্তু পাষ- হোটেল মালিকের মন গলেনি। হত্যার পরই ঘরোয়া হোটেলের মালিকের আত্মা শান্তি পায়। হত্যার পর গাড়ি হাঁকিয়ে বীরদর্পে চলে যান। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ছিনতাইকারীদের গুলিতে রিয়াদ মারা গেছে বলে অপপ্রচার চালানো হয়। রিয়াদ হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী হোটেল কর্মচারী জসীম গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এসেছে এমন রোমহর্ষক কাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটির বৈধ কোন কাগজপত্র বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হত্যাকারী প্রসিদ্ধ ঘরোয়া হোটেলের মালিক, ম্যানেজার ও এক কর্মচারীসহ মোট ৩ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। জসীম নামে এক কর্মচারী গ্রেফতার হয়েছে। মালিক ও ম্যানেজার পলাতক। বিমানবন্দর ও বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে পলাতক দুইজনের ছবি ও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। ঘটনা তদন্তে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তার পর্যালোচনা চলছে। মঙ্গলবার রাত ১টায় রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন স্বামীবাগের ৭৩ নম্বর নির্মাণাধীন বাড়ির দ্বিতীয় তলায় রিয়াদ হোসেনকে (১৬) বেঁধে নির্মম নির্যাতনের পর মুখে আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঢুকিয়ে ঘরোয়া হোটেলের মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। নিহতের পিতার নাম মফিজ উদ্দিন (মৃত)। বাড়ি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার হাড়িয়াইন সাহেব বাড়ি গ্রামে। মামলার বাদী নিহতের বড়ভাই রিপন হোসেন জানান, তিনি ৪ বছর আগে মতিঝিল ঘরোয়া হোটেলে রুটি তৈরির হেলপার হিসেবে চাকরি করেছেন। সেই সুবাদে মালিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয়। সম্পর্কের সূত্রধরে রিয়াদ ও তার খালাত ভাই মাইনুদ্দিনের প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে একই হোটেলে চাকরি হয়। ২ বছর আগে তিনি ঘরোয়া হোটেলের চাকরি ছেড়ে রাজধানীর পল্টন থানাধীন ফকিরাপুল কমিশনার রোডের কাঁচাবাজারের ওমর গলিতে ভাই ভাই হালিম সুইটস নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ঘরোয়া হোটেল থেকে রিয়াদের ফোন থেকে তাকে ফোন করা হয়। তাকে জানানো হয়, রিয়াদের মোবাইল ফোনটি খোয়া গেছে। ফোনটি শরীয়তপুরে রয়েছে। এর কারণ জানার আগেই লাইন কেটে দেয়া হয়। একপর্যায়ে আর যোগাযোগ করতে না পেরে তিনি সরাসরি রাত ৮টার দিকে ঘরোয়া হোটেলে যান। হোটেল কর্মচারী রমজান তাকে জানায়, একটি মোবাইল ফোন চুরির ঘটনায় হোটেল মালিকের নির্দেশে সন্দেহজনকভাবে রিয়াদকে রশি দিয়ে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে হোটেলের দ্বিতীয় তলায় রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, তার ভাইকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তাকে বাড়তি রশি দিয়ে হোটেলের জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। রিয়াদ তাকে জানায়, হোটেলের কর্মচারীরা তাঁকে মিথ্যা চোর সাজিয়ে এমন অবস্থায় মারধর করে বেঁধে রেখেছে। আমি হোটেল ম্যানেজার শফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ভাইকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করি ম্যানেজারকে। ভাই যদি কোন অপরাধ করে থাকে এবং কোন কিছু চুরি করে থাকে, সে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিচ্ছি, তবুও ভাইকে ছেড়ে দেন। ম্যানেজার জানান, বিষয়টি মালিকের ওপর নির্ভর করছে। মালিক এলেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। এমন কথার পর আমি ও ম্যানেজার হোটেলের সামনে চায়ের দোকানে মালিকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ঘরোয়া হোটেলের মালিকের বাসা পল্টন থানাধীন ৮৮ নম্বর শান্তিনগর (পুরনো ৫৯ নম্বর) চামেলীবাগের ইস্টার্ন পিয়ারের ২/৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হোটেল মালিক একটি পাজেরো গাড়িতে করে হোটেলে আসেন। আমি হোটেল মালিককে বিষয়টি বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি কোন কথাই শুনলেন না। হোটেলের গ্রিল কারিগর জসীমসহ অজ্ঞাত ৩-৪ জনকে রিয়াদকে বাঁধা অবস্থায়ই পাজেরো গাড়িতে তুলে দিতে বলেন। তারা তাই করলেন। গাড়িতে তুলে রিয়াদকে নিয়ে দ্রুত গাড়িটি চলে যায়। গাড়িতে জসীমও সঙ্গে যায়। হত্যাকা-ের পর জসীম হোটেল মালিকের সঙ্গেই গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর পরই পুলিশ জসীমকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। হত্যাকা-ের পুরো ঘটনাই ঘটেছে জসীমের সামনে। জসীম তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছে, রিয়াদকে স্বামীবাগের ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মালিকের নির্দেশে হোটেল কর্মচারী মেছিয়ার খবিরসহ ৩-৪ জন নির্মাণাধীন বাড়ির দ্বিতীয় তলায় খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলে রিয়াদকে। এরপর হোটেল মালিক সোহেল ও তার সহযোগীরা বাঁশ এবং কাঠের লাঠি দিয়ে রিয়াদকে বেধড়ক মারধর শুরু করে। রিয়াদের শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। তার চিৎকার যাতে বাইরে না যায় এ জন্য রিয়াদকে শাসাতে থাকে। রিয়াদ বাঁচার জন্য হাউমাউ করে কেঁদে বহুবার জীবন ভিক্ষা চায়। কিন্তু পাষ- হোটেল মালিকের মন গলেনি। একপর্যায়ে কোমর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে তার নল রিয়াদের ডান চোয়ালে ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেন। বিকট শব্দ শেষে সব শান্ত হয়ে যায়। রিয়াদের নিথর দেহ বাঁধা থাকা অবস্থায় কাঁত হয়ে পড়ে থাকে খুঁটির সঙ্গে। রিয়াদের মুখের ভেতরের সব রক্তনালী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মুখ থেকে অনবরত রক্ত পড়তে থাকে। পুরো ফ্লোর রক্তে লাল হয়ে যায়। হত্যার পর হোটেলের ৪-৫ জন স্টাফকে দিয়ে রিয়াদকে মৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে, হোটেল মালিকের নির্দেশে কর্মচারীরা জানায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে রিয়াদের মৃত্যু হয়েছে। এরপর সবাই আস্তে পালিয়ে যায়। সোহেলের বাসায় তালা। তারা আত্মগোপনে চলে গেছে। রিপন জনকণ্ঠকে বলেন, হোটেলের বাবুর্চী বিল্লাল তাকে তার ভাই হোটেল মালিকের গুলিতে মারা যাওয়ার সংবাদ মোবাইল ফোনে দেন। এরপর তিনি হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে শনাক্ত করেন। বুধবার রাতে রিয়াদের মুখের ভেতরের দিকে ঘাড় থেকে একটি বুলেট উদ্ধার হয়। হাঁটুর ওপরের দিকে আরেকটি গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন রয়েছে। তবে গুলিটি মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায় বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন। বুধবার রাতেই লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় জানাজা শেষে গ্রামের বাড়িতে রিয়াদকে দাফন করা হয়েছে। এমন ঘটনায় পরিবারে চলছে মাতম। শত শত মানুষ ভিড় করছিলেন রিয়াদের বাড়িতে। তাদের আহাজারিতে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আছে। এ ব্যাপারে ওয়ারী থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার শুরু থেকে রিয়াদকে হত্যা পর্যন্ত হোটেল মালিকের সঙ্গে জসীম ছিল। হত্যার পর জসীম হোটেল মালিকের গাড়িতে করেই পালিয়ে যায়। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বেশ কয়েক কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে তাদের কাউকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আটক বা গ্রেফতার দেখানো হয়নি।
×