ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ কাল

চট্টগ্রামে আকাশভাঙ্গা বর্ষণ, বিপর্যস্ত জনজীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৫ জুলাই ২০১৫

চট্টগ্রামে আকাশভাঙ্গা বর্ষণ, বিপর্যস্ত জনজীবন

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ‘নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে/তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’- কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আষাঢ়ীও বর্ষাকে নিয়ে লেখা কবিতার এ কটি লাইন। কিন্তু এখন চলছে শ্রাবণ। শ্রাবণেও থাকে বর্ষার চিরায়ত রূপ। শুক্রবার ছিল ৯ শ্রাবণ। অবিরাম বর্ষণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জীবনযাত্রায় নেমে আসে দুঃসহ পরিস্থিতি। একেবারে নাকাল জনজীবন। এদিন ছিল বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফিকার টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিন। কিন্তু বাদ সেধে বসে বর্ষণ। হলো না। স্বাগতিক দেশের এ ক্রিকেট যুদ্ধ দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা, ঘর থেকে বেরুবার সুযোগও মিলল না। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই কালো মেঘে ছেয়ে যায় চট্টগ্রামের আকাশ। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি, পরে অঝোর ধারা। শুক্রবার সকাল থেকে যেন আকাশ ভেঙ্গে এলো বর্ষণ। ধীরে ধীরে গতি আরও বাড়ল। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পানিতে তলিয়ে গেল এ নগরীর বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল। ছুটির দিন হলেও মানুষের বহুবিধ কর্মকা- থমকে গেল। শুধু তাই নয়, নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই তলিয়ে গেল পানিতে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতি কত তার পরিসংখ্যান করা দুঃসাধ্য। তবে দুর্ভোগ চরমে। পূর্ব নির্ধারিত অনুযায়ী যাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ছিল সবই রীতিমতো প-। যে যেভাবে পারে সেভাবে কোনরকমের সেরে নিয়েছে। চট্টগ্রামে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে ৩৮ মিলিমিটারেরও বেশি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বর্ষণমুখরিত এ পরিবেশ প্রকৃতিকে নাচালেও মানুষের নিত্য দুর্ভোগকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভরাট হয়ে থাকা এ নগরীর নালা ও খাল জলজটে তলিয়ে যায়। ফলে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা যেমন থমকে যায়, তেমনি থমকে যায় যানবাহনের গতিও। এমনিতর বর্ষণের মাসে আগামীকাল ২৬ জুলাই এ নগরীর নবনির্বাচিত মেয়র হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন আ জ ম নাছির উদ্দিন। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সবচেয়ে বেশি তার মনে। মেয়র নির্বাচন করেছিলেন প্রচ- দাপদাহ মাথায় নিয়ে। রাত-দিন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ছুটতে গিয়ে শরীর থেকে ঘাম ঝরেছে পানির মতো। আর এখন ক্ষমতায় বসার লগ্নে আকাশ ফেটে পড়ছে বৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই নগরবাসীর দুশ্চিন্তা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে ক্ষোভও। যার শেষ গন্তব্য থাকে সিটি কর্পোরেশনের প্রতি। যা বজ্রঘাত সমতুল্য হয় মেয়রের জন্য। প্রতিবছরই বর্ষা এলে বন্দরনগরীর পরিস্থিতি এ ধরনেরই হয়ে থাকে। এটা কোন নতুন নয়। তবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে দিনে দিনে। এ ক্ষোভ প্রশমিত করতে ইতোমধ্যেই উদ্যোগী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। ঘোষণার বাস্তবায়ন ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে সাধারণ মানুষ মনে করেন না পারার কিছু নেই। নালা নর্দমা ও খালের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং জলজট পরিস্থিতি অবসানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই এ দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব কিছু নির্ভর করছে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মদক্ষতা। বর্ষণে ইতোমধ্যেই রাস্তাঘাটের করুণ হাল হয়ে গেছে। খানা খন্দকে ভরে গেছে প্রধান প্রধান সড়কগুলোও। সুষ্ঠু যান চলাচল যেখানে দায় হয়ে পড়ছে সেখানে যাত্রীদের অবস্থা তথৈইবচ। বর্ষণমুখর সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত সর্বত্র বৃষ্টির জমাট পানি। অপসারণের সুযোগ নেই। বৃষ্টি একটু থামলেই পানিও কমছে। আবার বাড়লে পানিও বাড়ে। এভাবেই মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কখনও গতি পাচ্ছে আবার কখনও স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। আর বৃষ্টির কারণে বাড়ি-ঘরে পানি ঢুকে যারা দুঃসহ অবস্থায় রয়েছে তাদের কষ্টের দিকটা কারও অজানা নয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম পাহাড় ঘেরা হলেও সমুদ্র ও নদী একে ঘিরে রেখেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে স্বাভাবিক জোয়ারেও এ নগরীর কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে বাড়তি দুর্ভোগ ডেকে আনছে কর্ণফুলী নদী। দিনে দিনে উজান থেকে নেমে আসা পলি মাটিতে মরতে বসেছে এ নদীটি। পলি ড্রেজিং করার উদ্যোগ আতুড় ঘরেই মরেছে বহু আগে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কোটি কোটি টাকার এ প্রকল্প ভেস্তে গেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কারণে। প্রকল্পের অর্ধেরেকও বেশি টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে যখন বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ঠিকাদারের কাজ বাতিল করে তখন তারা আবার আদালতে মামলাও ঠুকে দেয়। ফলে গ্যাড়াকলে পড়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কাজ বন্ধ। আর পলি আসা অব্যাহত। এছাড়াও এ নদীর দু’পাড়জুড়ে দখলদারিত্ব। ফলে ক্রমেই এ নদীর প্রশস্ততা হ্রাস পেয়েছে। পলি জমে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য চর। বড় জাহাজ চলাচলের কোন সুযোগ নেই। ছোট নৌযানগুলোও ক্ষণে ক্ষণে আটকে যায়। এ নদীর উভয় পাশে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা কঠিন। এরা সরকারদলীয় প্রভাবে প্রভাবশালী। তার উপর রয়েছে আদালতের নানা নির্দেশনা। ফলে অসহায় হয়ে আছে এ নদীর তলদেশ ড্রেজিং ও দু’পাড়ের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম। এ নগরীতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। আবার বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবেও খ্যাত। কিন্তু এর যে বর্তমান শ্রী তা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কিংবা বাণিজ্যিক রাজধানীর নামের সঙ্গে মেলানো যায় না। বর্তমান সরকার এ নগরীর উন্নয়নে ঘোষণা করেছে বহু প্রকল্প। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে হবে দেশের প্রথম টানেল। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য হচ্ছে পৃথক পৃথক বিশেষ জোন। কিন্তু অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে বহু পিছিয়ে রয়েছে এ নগর। চাহিদার বিদ্যুত নেই। পানি নেই। গ্যাসের অবস্থা ভয়াবহ। নির্মিত হয়ে আছে এমন বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ হচ্ছে না। সুপেয় পানির জন্য মানুষের মাঝে হাহাকার অবস্থা। বিদ্যুত আসে বিদ্যুত যায়। লোডশেডিং চরম পর্যায়ে। কারখানায় উৎপাদন চলে তো আবার বন্ধ। এমনিতর পরিস্থিতিতে বর্ষার আগমন হয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। যাওয়ার মুহূর্তে বর্ষণ পরিস্থিতি এ নগরকে ডুবিয়ে দিচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যার কারণে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণে নগরবাসী এখন চেয়ে আছে নবনির্বাচিত নগর প্রশাসনের প্রতি, অর্থাৎ নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের দিকে। রাস্তাঘাট মেরামত, জলজট সমস্যা নিরসন, দ্রুততম সময়ে করাও অসম্ভব। তবে ব্যবস্থা গ্রহণের দিকটি নজরে এলেই মানুষের মনে উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে নবরূপে। এ আশা নিয়েই মানুষের প্রতীক্ষার ক্ষণ গণনা চলছে।
×