ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি-আ’লীগ নেতা একাট্টা

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২৯ মার্চ ২০১৫

বিএনপি-আ’লীগ নেতা একাট্টা

নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী, বরগুনা, ২৮ মার্চ ॥ তালতলী উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা গ্রামের ১৪ হিন্দু পরিবার সন্ত্রাসী আবদুর রশিদ ও জাকির সরদারের অত্যাচারে পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, উপজেলার চন্দনতলা গ্রামে হরেন কান্ত, নিলা রানী সরকার, যাদব চন্দ্র সরকার, ধীরেন সরকার, মাধব সরকার, সুভাষ চন্দ্র সরকার, রমেশ চন্দ্র সরকার, বাবুল চন্দ্র সরকার, কার্তিক সরকার, রিপন সরকার, জিতেন্দ্র সরকার, সুমন্ত সরকার, রণজিৎ সরকার ও শ্যামল সরকার দীর্ঘদিন ধরে পৈত্রিক সম্পত্তিতে বসবাস করে আসছে। এরা কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করে জীবন যাপন করে। এ পরিবারগুলোর ভিটাসহ ৪০ একর কৃষি জমি রয়েছে। এ জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সন্ত্রাসী আবদুর রশিদ আকন, আ’লীগ নেতা আঃ ছালাম ও যুবলীগ নেতা জাকির সরদারের। এক সময় জাকির সরদার ও রশিদ আকনের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল। ফলে আবদুর রশিদ হিন্দুদের জমি দখল করতে সাহস পায়নি। সম্প্রতি এদের মধ্যে হিন্দুদের জমি দখলের সমঝোতা হয়েছে। যুব লীগ নেতা জাকির সরদারের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। এ বাহিনীর ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। সন্ত্রাসী বাহিনী দখলদাড়িত্বের নব কৌশল আবিষ্কার করে। এ তিন নেতার নেতৃত্বে মস্তানদের হিন্দু বাড়িতে পাঠিয়ে মেয়েদের বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। সন্ধ্যার পরে বাসা বাড়িতে ভূতের আছরের ভয় দেখিয়ে ঢিল ছোড়া নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল পড়ুয়া মেয়েরা বিদ্যালয়ে যাওয়া ও আসার পথে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এমনও অভিযোগ রয়েছে সন্ত্রাসী রশিদ আকন ও জাকির সরদারের মনবাসনা পূরণের জন্য হিন্দুদের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে ও গৃহবধূকে তাদের কাছে যেতে হয়। লোকলজ্জায় কাউকে না বলে দীর্ঘ দিন সহ্য করে। এ রকম ঘটনা প্রতিদিন ঘটিয়ে হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। যাতে তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওদের ভয়ে ২ বছর পূর্বে জিতেন্দ্র সরকার, সুমন্ত সরকার, রণজিৎ সরকার ও শ্যামল সরকারের পরিবার পৈত্রিক ভিটা বাড়ি ছেড়ে বরগুনার আশ্রয় নেয়। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ৮ পরিবার বরগুনা সদর ও ২ পরিবার ছোটবগী বাজারের আবাসন কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। শনিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এ ১৪ হিন্দু পরিবারগুলোর ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গাছপালা কেটে নেয়া হচ্ছে। শূন্য ভিটায় কার্তিক সরকারের স্ত্রী শেফালী রানীর আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। অসহায় শেফালী রানী শূন্য ভিটা দেখিয়ে বলেন “মোগো সব ওরা কাইর‌্যা লইয়্যা গ্যাছে মোরা এ্যহন খালী পইড়্যা রইছি। খালি ভিটিতে আইলেও ওরা মোগো মাইর‌্যা হালানের ভয় দ্যাহায়”। শেফালী ও নীলা রানী সরকার বর্তমানে ছোটবগী আবাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। মাঝে মধ্যে এ শূন্য ভিটায় এসে আহাজারি করে যায়। প্রতিবেশী মাওলানা আবদুল জলিল জানান, ২০০২ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে বিএনপি নেতা আবদুর রশিদ আকন এ হিন্দু পরিবারগুলোকে উচ্ছেদের জন্য বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করলে আবদুর রশিদ এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। ওই সময় হিন্দুদের পক্ষে ছিল আবদুস ছালাম ও জাকির সরদার। ২০১০ সালে অবদুর রশিদ এলাকায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস ছালাম সরদার ও যুবলীগ নেতা জাকির সরদারের সঙ্গে হিন্দু পরিবারগুলোর জমি দখল করার জন্য সমঝোতা করে। এর প্রেক্ষিতে হিন্দু পরিবারের ওপর নতুন করে অত্যাচার নির্যাতন শুরু হয়। ওদের নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ যে, ৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদেরও হার মানায়। শুধু মাত্র কৌশল পরিবর্তন করা হয়। ওদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কথা এলাকাবাসী বলতেও সাহস পায় না। তিনি আরও জানান, গত ১২ মার্চ রাতে এ পরিবারগুলো বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। এদিকে ১৩ মার্চ আবদুর রশিদ ও জাকির সরদার সন্ত্রাসী বাহিনীর গাববাড়িয়া গ্রামের বশির তালুকদার, জাহাঙ্গীর মিয়া, আবদুর রহিম, স্বপন মিয়া, চন্দনতলা গ্রামের মানিক হাওলাদার ও হেলেঞ্চাবাড়িয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের সহায়তায় ১০ পরিবারের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে ও মালামাল প্রকাশ্য দিবালোকে লুটপাট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে যাদব চন্দ্র সরকার গত ২৩ মার্চ তালতলী থানায় মুনসুর আকনের ছেলে আবদুর রশিদ আকনকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করে। পুলিশ আবদুর রশিদকে গ্রেফতার করেছে। ইত্যবসরে বরগুনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বর্তমানে ওই বাড়িগুলোতে চৌকিদার মোঃ সৈয়দ আহম্মেদ ও দফাদার মোঃ সোলায়মান পাহারা দিচ্ছে। তারা জানান, লুণ্ঠিত কিছু মালামাল বশির তালুকদার, জাহাঙ্গীর, আবদুর রহিম, স্বপন, মানিক হাওলাদার ও জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে জব্দ করা হয়েছে। কাপালী কান্দা গ্রামের হরিদাশ জানান “হিন্দুপাড়ায় লুট অইছে, মোরা ডরে হেইহানে যাই না”। জয়ালভাঙ্গা গ্রামের বৃদ্ধ ওসমান শিকদার জানান, হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই। এক ভাই আরেক ভাইকে এভাবে নির্যাতন করে বাড়িছাড়া করবে তা মেনে নেয়া যায়না। তিনি আরো জানান ওই গ্রামে যে নির্যাতন হয়েছে তা মুখে বলার কথা নয়। মা বোনতে ওদেরও আছে। কিন্তু হিন্দুরা এগুলো ভয়ে বলতে চায় না। কড়াইতলা গ্রামের নিখিল চন্দ্র ঘরামি ও রতন চন্দ্র হাওলাদার জানান, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে পার্শ্ববর্তী গ্রামে এর প্রভাব পড়বে। আমরা এর বিচার চাই। পচাকোড়ালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নজির হোসেন কালু পাটোয়ারী জানান হিন্দু গ্রামের ঘটনা বলার মতো নয়। সন্ত্রাসীরা দিনের পর দিন এভাবে নির্যাতন করেছে এ কথা হিন্দুরা কখনো বলেনি। যখন লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে তখন আমারা জানতে পারি। তালতলী থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতার জানান, এ ঘটনার মূল আসামি আবদুর রশিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাড়ি ছাড়া হিন্দু পরিবারগুলো যাতে বাড়ি ফিরে এসে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×