ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনবিআর কর্মকর্তাকে গুলিবর্ষণ ছিল পরিকল্পিত

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ মার্চ ২০১৫

এনবিআর কর্মকর্তাকে গুলিবর্ষণ ছিল পরিকল্পিত

আজাদ সুলায়মান ॥ নিজ বাসার সামনে হাঁটার সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (মূসক) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেনকে গুলি করাটা ছিল পরিকল্পিত। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হলিউড ফিল্মি কায়দায় উপর্যুপরি গুলি করা হয়। কিন্তু ঘাতকের একটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সৌভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। যদিও তাঁর অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁর সফল অস্ত্রোপচার হলেও পরবর্তী বারো ঘণ্টার আগে চিকিৎসকরা কিছুতেই তাঁকে শঙ্কামুক্ত বলে ঘোষণা দিতে পারেননি। এদিকে চাঞ্চল্যকর এ হামলায় কারা জড়িত বা কি কারণে তাকে গুলি করা হলো সেটা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। পুিলশ এ ঘটনায় কাউকে আটকও করতে পারেনি। বনানী থানার পুলিশ এ ঘটনাকে শুধু পরিকল্পিত বলে দাবি করলেও মোটিভ সম্পর্কে কোন ধারণা দিতে পারছে না। ওসি ভুইয়া মাহবুব জনকণ্ঠকে বলেছেন, “জাহাঙ্গীর আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন। তাঁর সঙ্গে আলাপ না করা পর্যন্ত কোন কিছুই ধারণা করার উপায় নেই। চাঞ্চল্যকর এই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘাতকদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, এটা অনাকাক্সিক্ষত। এদিকে মঙ্গলবার দুপুুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে ঘাতকরা কমান্ডো স্টাইলে এ হামলা করে নির্বিঘেœ চলে গেছে। কেউ তাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি। অনেক লোক আশ পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীরের ওপর হামলার দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখলেও তারা চিৎকারও করেননি। এমন কি গুলি খেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় জাহাঙ্গীর চিৎকার করে বলেছেন, ‘আমাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করছে তোমরা গেট আটকাও।’ এমন আর্তনাদ করার পরও কেউ এগিয়ে আসেনি। গেটে থাকা দুটো নিরস্ত্র সিপাহীও ভয়ে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, মহাখালী ২নং সড়কের মাঝামাঝি ভেতরের একটা লেনের পাশে কাস্টমস আবগারি ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার। গেটের বাইরে একটা নেমপ্লেটেই লেখা রয়েছে এটা তাদের কোয়ার্টার। কোয়ার্টারের চারপাশে রয়েছে আবাসিক এলাকার ঘন বসতি। সামনে তিতুমীর কলেজের পেছনাংশের দেয়াল। কাস্টমস কোয়ার্টার হিসেবে এর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। চারদেয়ালের মাঝখানেই এ কোয়ার্টার। ভেতরে প্রবেশ ও বের হওয়ার একটাই গেট। ভেতরে প্রচুর গাছ গাছালির ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশ সব সময় নীরব নিস্তব্ধ। গেটের কাছে পালাক্রমে কাস্টমসের দু’জন নিরস্ত্র সিপাহী দায়িত্ব পালন করেন। নিরাপত্তার দায়িত্ব বলতে শুধু বসে বসে সময় কাটানো। ভেতরে কে এলো, কে সে তা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। এরকম নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে একদম শেষ প্রান্তের একটি চারতলা ভবনের দু’ তলার বাসাতে থাকেন ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর। তিনি গত ষোলো বছর ধরে এই ভবনে বসবাস করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালের চাখারে। তাঁর এক ছেলে মনির ব্রিটিশ টোব্যাকোতে চাকরি করেন। একমাত্র মেয়ে জ্যোতি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ সুখীময় জীবন তাঁর। ব্যক্তিগতভাবেও বেশ অমায়িক ও বিনয়ী। পেশাগত জীবনেও ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীরের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। সহকর্মীদের মতে, তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন সৎ ন্যায়নিষ্ঠ ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত। তারপরও সর্বশেষ মূসকের সদস্য হিসেবে যোগদানের আগে কর্মস্থলে তিনি ছিলেন কিছুটা কোণঠাসা। সূত্র জানায়, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নজিবুর রহমান যোগদানের পর ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীরকে ভ্যাটের নীতিনির্ধারণীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় ভ্যাটের আগামী অর্থবছরের নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত গুরুদায়িত্ব তাকেই পালন করতে হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। প্রত্যক্ষদর্শী এক মহিলা জনকণ্ঠকে জানান, গুলির শব্দে তিনি বারান্দায় এসে দেখেন একটা গাড়ি দ্রুত ছুটছে গেটের দিকে। গেটে দায়িত্বরত কাস্টমসের দুই সিপাহী ইয়াহিয়া ও দিবাকর গাড়িটি আটকের কোন চেষ্টা করেননি। ঘাতকদের একজন গাড়ি থেকে নেমেই গেট খুলে নির্বিঘেœ চলে যেতে সক্ষম হয়। ঘাতকদের ড্যামকেয়ার মনোভাব দেখেও পাশের দোকানের প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদেরকে সন্দেহও করতে পারেনি। এ বিষয়ে ওই কোয়ার্টারে বসবাসরত একজন বাসিন্দা যথেষ্ট ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার জন্যই ঘাতকরা এত সহজে হলিউড ফিল্মি স্টাইলে এমন অবিশ্বাস্য অপরাধ করার সুযোগ নিয়েছে। অজ্ঞাত একটি গাড়ি মূল গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল, দারোয়ান বাধা দেয়নি। গুলি করে আবার চলেও গেল কোন প্রতিকার প্রতিরোধেও কেউ সাহায্য করেনি। গুলি খেয়ে জাহাঙ্গীর চিৎকার করল ঘাতকদের ধরার জন্য- তবুও কেউ এগিয়ে এসে কোন ধরনের সহযোগিতা করেনি। রাস্তায় গাড়িটি দ্বিতীয় দফা স্টার্ট দেয়ার সময়ও কেউ চিৎকার করে বলেনি, ওতে অস্ত্রধারী খুনী রয়েছে। এমন দুর্বল নিরাপত্তা ও প্রতিবেশীদের মাঝেই কাস্টমস কর্মকর্তাদের বসবাস। জানা যায়, ওই কোয়ার্টারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কজন সদস্য, কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডিজি ও এসি লেভেলের প্রায় গোটা ৩০ জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বসবাস। তারা সবাই এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। এ কোয়ার্টারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়ে অনেকেই আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারপরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখানেই বাস করেন শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান। যিনি সাম্প্রতিক বড় বড় সোনা চোরাচালানসহ অন্যান্য গডফাদারদের অবৈধ ব্যবসার ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে চোরাচালানিদের ভিত নড়িয়ে দিয়েছেন। তিনিও চরম নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে অনেক আগে থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রতিকার চেয়েছিলেন। এতদিন তার আহ্বানে সাড়া মেলেনি। তবে ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীরকে গুলির পর প্রশাসনের টনক নড়ে। এবং গতকাল মঙ্গলবারই ডক্টর মইনুলকে পুলিশ সদর দফতর থেকে একজন সার্বক্ষণিক গানম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। জানতে চাইলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, “রাজস্ব বোর্ডের আবেদনের পরই ডক্টর মইনুল খানের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার স্বার্থে একজন গানম্যান দেয়া হলো। প্রয়োজনে অন্যদেরকেও বিবেচনা করা হতে পারে। কি কারণে এ হামলা ॥ ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীরের ওপর এমন নৃশংস হামলা হতে পারে এটি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তার পরিবার ও সহকর্মীরা। এটা ব্যক্তিগত শত্রুতা নাকি পেশাগত বিরোধের জের ধরে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে সেটাই খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ সম্পর্কে তাঁর মেয়ে জ্যোতি জনকণ্ঠকে বলেন, “আব্বার কোন শত্রু ছিল না। সারা জীবনেও তিনি কারও সঙ্গে কোন খারাপ আচরণ করেননি। এমনকি অফিসেও কারও সঙ্গে কোন মনোমালিন্য আছে বলে জানা নেই। কেউ তাকে হুমকি দিলেও তো তিনি বাসায় বলতেন। তাহলে কেন তাকে গুলি করা হলো। এখন খুনীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করলেই সব রহস্য বের হবে।” ঘাতকদের গ্রেফতারের নির্দেশ চেয়ারম্যানের ॥ এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেনের ওপর হামলাকারী দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন বলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। মঙ্গলবার ফেসবুকের ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক স্ট্যাটাসে তিনি এ দাবি করেন। নজিবুর রহমান স্বল্পোন্নত দেশের বিকল্প সদস্য হিসেবে ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড বোর্ড সভায় যোগ দিয়ে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছেন। তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর এনবিআর ও কর প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তার ওপর অনাকাক্সিক্ষত হামলায় তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। এ রকম একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের ওপর হামলায় এনবিআর’র সব সদস্য মর্মাহত হয়েছেন। অফিসিয়াল কাজে আমি সশরীরে ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীরের পাশে থাকতে না পারলেও আমার সব সহকর্মীদের তাদের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছি। তার সুস্থতা প্রার্থনা করি।
×