ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশীদের কাছে টানতে সব চেষ্টা শেষ বিএনপির ॥ কোন রাষ্ট্রই পাশে নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিদেশীদের কাছে টানতে সব চেষ্টা শেষ বিএনপির ॥ কোন রাষ্ট্রই পাশে নেই

তৌহিদুর রহমান ॥ বিদেশীদের প্রতি ভরসা করে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে গেলেও এখন কোন রাষ্ট্রই তাদের পাশে নেই। অপরপক্ষে বিদেশী দেশগুলো মনে করছে বর্তমান সরকার অতীতের চেয়ে এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। বিরোধী দল দেশে একটি ‘ত্রাসের পরিবেশ’ সৃষ্টি করছে বলেও মনে করেন তারা। আন্দোলনের নামে পেট্রোলবোমা, জ্বালাও-পোড়াও, নিরীহ মানুষ হত্যা, জনসম্পৃক্ততা না থাকা ইত্যাদির কারণে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিতে পারছেন না বিদেশীরা। এছাড়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংলাপের যৌক্তিতা আছে কি-না সেটা ভেবে দেখছে জাতিসংঘ। বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোট প্রায় দেড় মাস ধরে টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে গেলেও কোন একটি বিদেশী রাষ্ট্রই এই কর্মসূূচীকে সমর্থন দেয়নি। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকরা বিএনপিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তারা বলেছেন বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচী চালিয়ে যেতে হবে। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী চালিয়ে যেতে ইতোমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির চলমান আন্দোলন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গলবার তাদের অবস্থান জানিয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশে নবযিুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাবে না। এই দেশের রাজনৈতিক সমস্যা এখানকার রাজনীতিবিদ ও জনগণই সমাধান করবে। তিনি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করতে বাংলাদেশে এসেছেন। এদিকে ভারত সরকার মনে করে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার আত্মবিশ্বাসী। এছাড়া জরুরী অবস্থা জারির বিষয়টি এখনও সরকারের বিবেচনায় আসেনি বলেও মনে করে দেশটি। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন দিল্লীতে পেশ করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধে গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও বোমাবাজিতে ‘ত্রাসের পরিবেশ’ সৃষ্টির বিষয়টিও স্বীকার করেছেন পঙ্কজ শরন। এক মাসেরও বেশি সময়ের অবরোধে নাশকতায় এরই মধ্যে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের অধিকাংশই পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। যেসব জেলায় বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছে সেগুলো চিহ্নিত করেছে ভারত। সেগুলোর মধ্যে ফেনী, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রংপুর, মাগুরা ও ঢাকা রয়েছে। ভারতীয় হাইকমিশনারের প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে হাসিনার সরকার। সহিংসতা দমনে বাংলাদেশ সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এবং তা কাজে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং এরই মধ্যে তারা বেশ সফলতাও পেয়েছে। ভারতের হাইকমিশনার প্রতিবেদনে জানান, পেট্রোলবোমা মেরে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যায় সাধারণ জনগণ বিক্ষোভকারীদের বিপক্ষে চলে গেছে এবং তা সহিংসতা দমনে জনসাধারণের সমর্থন পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছে। বিএনপির টানা আন্দোলনের মধ্যেই গত সপ্তাহে বাংলাদেশের যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার তাগিদ দেন। তিনি শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকলপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানান। তবে তিনি সেখানে কোন সংলাপের কথা বলেননি। এছাড়া সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর বৈঠক হয়েছে। তবে কোন পক্ষই বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সংলাপ বা নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে মতামত দেয়নি। এদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো ঢাকা আসছেন বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর এলেও এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জাতিসংঘ মহাসচিবের সহযোগী মুখপাত্র এরি কানেকো জানিয়েছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এ মোমেনও মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে তারানকোর ঢাকা সফর সম্পর্কেও কোন তথ্য দিতে পারেননি। ফলে তারানকোর ঢাকা সফর অনেকটাই অনিশ্চিত বলে জানা গেছে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের যৌক্তিকতা আছে কি-না সেটাই এখন ভেবে দেখছে জাতিসংঘ। সেটা না থাকলে তারানকো বাংলাদেশে আসবেন না বলেও জানা গেছে। এর আগে জাতিসংঘ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানিতে সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্বেগের কথা জানায়। এদিকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে জানিয়েছেন, ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্করকে ঢাকা পাঠাবেন তিনি। টেলিফোনে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে বলেও জানান মোদি। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। সেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়েও আলাপ হবে বলে জানা গেছে। তবে বিএনপির টানা আন্দোলনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে জন কেরির বৈঠকÑএই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সুসম্পর্কের বার্তা বয়ে এনেছে। এই ঘটনায় সরকার এখন অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিদেশীদের প্রতি ভর করে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে গেলেও এসব ঘটনায় এখন আর তারা সুবিধা করতে পারছে না। সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট বিভিন্ন কৌশল নেয়। এই কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ভারতের বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ টেলিফোন করেছেন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের সই জাল করে বিএনপির পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন বলেও প্রচারণা চালানো হয়। তবে সেসব প্রচারণা ফাঁস হয়ে পড়ে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ নিজেই জানান, তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনকে কোন ফোন করেননি। এছাড়া মার্কিন কংগ্রেসম্যানরাও পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জানান, তারা কোন বিবৃতি দেননি। এই ঘটনার পরে বিপাকে পড়ে বিএনপি। বিএনপির ডাকা চলমান হরতাল-অবরোধের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই চার দফায় ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সরকারের সঙ্গে বিদেশী কূটনীতিকদের নিয়ে প্রথম দফায় ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, কানাডা, ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হয়। তৃতীয় দফায় সার্ক ও আসিয়ান দেশের প্রতিনিধি ও চতুর্থ দফায় ওআইসি ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গত ১৪ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে বিদেশী কূটনীতিকরা আন্দোলনের নামে সহিংসতা কঠোর হাতে দমন করতে তাগিদ দিয়েছেন তারা। বিএনপি আন্দোলনের নামে সহিংসতা করছে বলেও অভিমত প্রকাশ করেন বিদেশী কূটনীতিকরা। একই সঙ্গে বিএনপিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার সুযোগ দেয়ার জন্যও আহ্বান জানান তারা। ইতোমধ্যেই কানাডা, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানের কূটনীতিকরা দেশের চলমান সহিংসতার তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন। এসব দেশের কূটনীতিকরা বলছেন, সহিংস কর্মকা- চালিয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করা যায় না। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় তারা তীব্র নিন্দা জানান। শান্তিপূর্ণ উপায়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের আহ্বানও জানিয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। সর্বশেষ মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সহিংসতার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সহিংসতা কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বে সরকার বিরোধীপক্ষ আন্দোলনের নামে ইতিমধ্যেই প্রায় ৯০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। পেট্রোলবোমার আঘাতে শত শত নিরীহ মানুষ আগুনে পুড়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত রয়েছেন। নজিরবিহীন এই সহিংসতার স্বরূপ তুলে ধরে ইতিমধ্যেই একটি ভিডিও চিত্র বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এসব ভিডিওচিত্র দেখে বিএনপির আন্দোলনের প্রতি সমর্থন না দিয়ে উল্টো ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিদেশীরা।
×