ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাগরিক শোকসভা ১৭ নবেম্বর

শ্রদ্ধা ভালবাসায় অন্তিম শয়ানে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১৪ নভেম্বর ২০১৪

শ্রদ্ধা ভালবাসায় অন্তিম শয়ানে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতি গঠনে আজীবন ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলো। প্রগতিশীল রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। আপন মনন ও কর্মকা-ে প্রকাশিত হয়েছে দেশ, মাটি ও মানুষের কথা। অংশ নিয়েছেন সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে। গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণে পালন করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব। আর তাই তো বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও লেখক অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে বিদায়বেলায় জাতি জানাল অসীম শ্রদ্ধা। বৃহস্পতিবার নানা স্তরের মানুষের গভীর শ্রদ্ধা-ভালবাসা নিবেদন শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তিন দফা জানাজা শেষে সন্ধ্যায় বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এর আগে তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসে সবাই উচ্চারণ করলেন, তাঁর নির্দেশিত পথ, তাঁর কর্ম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সৃষ্টিশীল কর্মকা-ে পথ দেখাবে। তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধে বিকশিত হতে। বৃহস্পতিবার সকালে অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের মরদেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর বহুল পরিচিত আঙিনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানে ছাত্র-শিক্ষকের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর অনুষ্ঠিত হয় মরহুমের প্রথম জানাজা। এরপর বেলা সোয়া ১১টার দিকে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ নিয়ে আসা হয় বাঙালিত্বের চেতনার স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে এখানেই তাঁকে হৃদয়ের ভালবাসা মেশানো শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সমাজের শিক্ষাবিদ, শিল্পী, ছাত্র, সংস্কৃতিকর্মী, মন্ত্রী, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর বাসভবনে। সেখানে আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো এক নজর দেখেন তাঁকে। কোরআনখানি ও দোয়াপাঠের পর গুলশান আজাদ মসজিদে বাদ আছর মরহুমের তৃতীয় দফা জানাজা শেষে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধায় সিক্ত করেন এই জ্ঞানতাপসকে। তাঁর স্মরণে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান যুগ্মসম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, ডাঃ দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম, আব্দুল মান্নান খান প্রমুখ। বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান দলের যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, আব্দুস সালামসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। এছাড়া সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, সাম্যবাদী পার্টির সভাপতি সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রফেসর ইমিরেটাস আনিসুজ্জামান, ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ আহমেদ ও অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন আবুল র্বাক আলভী, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপিকা জাহানারা খানম, অধ্যাপক গোলাম রহমান, সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, নারীনেত্রী শিরীন আখতার, ম. হামিদ, প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, কণ্ঠশীলনের জহুরুল হক খান প্রমুখ। সাংগঠনিকভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় জাসদ, সিপিবি, বাসদ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ, ছায়ানট, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, গণসাক্ষরতা অভিযান, গণসাহায্য সংস্থা, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা, ঐক্য ন্যাপ, মৈত্রী থিয়েটার, রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, সাম্যবাদী দল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক ও সংগঠন। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে রাষ্ট্রের প্রতি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ভূমিকা তুলে ধরে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, তিনি সবসময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। সকল কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে সকলের মধ্যে মুক্তচিন্তার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন। আর প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে তরুণ প্রজন্ম তাঁর এই আদর্শিক কর্মকা- থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিনি উদার গণতান্ত্রিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখতেন। সেই বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করতেন, যা এ সমাজে খুব অভাব। তাঁর আরেক পরিচয় হলো তিনি কবি ছিলেন। কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর এই কবি চরিত্র সব কাজে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সব কাজেই প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়েছে কবির নিস্পৃহতা ও সততার স্বভাব। ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেন, বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এক মানুষ ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি একাধারে কবি, শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক ছিলেন। এমন মানুষের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন। অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য তিনি অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মকা- তরুণদের পথ দেখিয়েছে, ভবিষ্যতেও দেখাবে। তিনি ছিলেন জাতির অভিভাবক। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, তাঁর গণতান্ত্রিক আদর্শের পথ ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের এগিয়ে চলায় পাথেয় হয়ে থাকবে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে জাতির শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। জাতির ক্রান্তিকালে তিনি ধীরস্থির নির্দেশনা দিয়েছেন। আবেগকে সংযত করে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। পাশাপাশি নাটক ও সংস্কৃতির বিকাশেও রেখেছেন সংবেদনশীল ভূমিকা। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর ছেলে ডাঃ শাকিল আক্তার বলেন, তিনি ছিলেন একজন সচেতন নাগরিক। প্রতিনিধিত্ব করেছেন নাগরিক সমাজের। এখানে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা এত লোকের উপস্থিতিই প্রমাণ করে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন তাঁর ছোট ছেলে ফারহাদ আনোয়ার ও একমাত্র মেয়ে। নাগরিক শোকসভা ॥ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, আগামী ১৭ নবেম্বর বিকেল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্মরণে নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে।
×