ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কলকাতায় জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকজনের নাম প্রকাশ

সাজিদকে বাংলাদেশ থেকে নির্দেশ পাঠাত জঙ্গী শাহেদা

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১১ নভেম্বর ২০১৪

সাজিদকে বাংলাদেশ থেকে নির্দেশ পাঠাত জঙ্গী শাহেদা

শংকর কুমার দে ॥ কলকাতায় আটক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) রহমত উল্লাহ শেখ সাজিদের আসল নাম মাসুদ রানা ওরফে মাসুম। ভারতে যার মাথার দাম ১০ লাখ রুপী ঘোষণা দেয়া হয়। সেই সাজিদ ধরা পড়ার পর আদালতে তোলা হলে সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, ‘প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসেছি, আমি কলকাতায়ই থাকতে চাই’। ভারতে আটক সাজিদ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন ফরাজীকান্দার জঙ্গী মাসুদ রানা মাসুম। একাধিকবার একাধিক নাম বদলে রহমত উল্লাহ শেখ ওরফে সাজিদ নামে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমানে গিয়ে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলে। পরে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনায় ধরা পড়ে। তার নাম পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। জেএমবির জঙ্গী নেতা সাজিদ ধরা পড়ার পর বলেছে, বাংলাদেশ থেকে শাহিদা নামের এক নারী জঙ্গী নির্দেশ দিত তাকে। শাহিদা নামে ওই নারী জঙ্গী ছাড়াও আরও কয়েকজনের নাম বলেছে, যাদের খোঁজে এখন অভিযান পরিচালনা করছে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন ইন্টেলিজেন্স (এনআইএ)। অসমে ধৃত নারী জঙ্গী প্রধান সুজেনা বেগম পুলিশ হেফাজতে নিয়ে অব্যাহত জেরা-জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও অনড়। তার স্বামী শাহনুর আলম ডাক্তারকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করার পরও ধরা পড়েনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশের জেএমবির সাজিদকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষণা এবং ধরা পড়া তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায় পরিচয় প্রকাশের পর অনুসন্ধান শুরু হয়। সাজিদের নাম রহমত উল্লাহ শেখ ওরফে বোরহান শেখ ওরফে মাসুদ রানা ওরফে মাসুম ইত্যাদি নানা নামের খোঁজ শুরু হয় নারায়ণগঞ্জে। না’গঞ্জ শহর থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে বন্দর থানাধীন ফরাজীকান্দা গ্রামের সাজিদের পরিচয় মেলে। নারায়নগঞ্জের ওপার বন্দরে এর আগেও মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গীর ঠিকানা রয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায়। মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গীর বিশেষ করে জেএমবির জঙ্গীর খোঁজে ইতোমধ্যেই বহুবার বন্দরের ফেরাজীকান্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি করে গেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ধরা পড়ে ফাঁসি হওয়া পর্যন্ত ঘটনায় মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গীর খোঁজ করে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দারা। নারায়ণগঞ্জের সালাউদ্দিন ওরফে সজিব নামে এক জেএমবির জঙ্গী গ্রেফতার হওয়ার পর ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা করে পুলিশ হত্যা করে জেএমবির জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনার সময়ে সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ওরফে সজিবকেও ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ কারণে বন্দর এলাকার কোন মহল্লা বা গ্রামের কার সন্তান জঙ্গী বা বিদেশে থাকে তা আশপাশের পরিচিত মানুষজনের জানা। ফরাজীকান্দা গ্রামের সাজিদ বলে ধরা পড়ার পর কলকাতায় পরিচয় দিয়েছে এই নামে এখানে কেউ নেই। তবে সাজিদ নামের যেই জঙ্গীর ছবি ছাপা হয়েছে সেই জঙ্গীর নাম সাজিদ না হলেও অন্য নামে চেনে বন্দরের মানুষজন। তবে বন্দর এলাকায় যেসব জঙ্গী থাকত তারা ছিল ভাড়াটে। সজিবের আসল পরিচয় ॥ পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যে সজিব ধরা পড়েছে সে ফারাজীকান্দার বাসিন্দা ছিল। তার এক ভাইয়ের নাম মনা। বন্দর এলাকার ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি। মনার দেয়া তথ্যে জানা গেছে, কলকাতায় ধরা পড়া জঙ্গীর যে ছবি দেখা গেছে সে তার ভাই। তবে তার নাম সাজিদ নয়, মাসুদ রানা ওরফে মাসুম। বাংলাদেশে থাকতে সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে দেখেছি। পারিবারিক নাম মাসুম। তারা চার ভাই, চার বোনের মধ্যে মাসুম সবার ছোট। ছোট বেলায় তাকে পড়াশোনার জন্য ঢাকার একটি মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। পরিবারের আশা ছিল বড় ধরনের এক আলেম হবে মাসুম। কিন্তু জঙ্গী সংগঠনের পাল্লায় পড়ে বিপথে চলে গেছে সে। আট থেকে দশ বছর ধরে পরিবারের কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। একবার শুনেছিলাম সে আফগানিস্তান চলে গেছে। বেঁচে আছে কিনা তাও আমরা জানি না। এখন শুনছি ভারতে ধরা পড়েছে। মনার কথায় জানা গেল, সজিব ধরা পড়ার পর তার নাম বলেছে, বুরহান শেখও। আসলে এটা তার নাম নয়, এটা তার মেজো ভাইয়ের নাম বুরহান শেখ। তিনি মালয়েশিয়ায় থাকেন। বড় ভাই কাইয়ুম ঢাকায় বাবুর্চির কাজ করেন। সেজো ভাই ঢাকায় কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। তার বাবার নাম সিদ্দিক মিয়া ওরফে পচা মিয়া। এলাকায় সবার কাছে পরিচিত পচা মিয়া নামে। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। শায়খ আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ॥ নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মাসুদ রানা ওরফে মাসুম নামের যে সাজিদ নামে কলকাতায় ধরা পড়েছে সে জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও তার ভাই আতাউর রহমান সানির ঘনিষ্ঠ। শায়খ আবদুর রহমান ও তার ভাই আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করার পর মাসুদ রানা জেএমবির সাংগঠনিক তৎপরতায় হাল ধরেন। কেন্দ্রীয় কমিটির মজলিস-এ-শূরার সদস্য মাসুম। সে কখনও রাজশাহী, কখনও বগুড়া আবার কখনও চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকত। তালেবানদের হয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্র লড়াইয়ের যোদ্ধারাও রয়েছে জেএমবিতে। গ্রেফতার হয় বগুড়াতে, চলে যায় ভারতে ॥ ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের ছয় নেতার ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর জেএমবিসহ জঙ্গী বিরোধী অভিযান জোরদার করা হলে মাসুদ রানা ওরফে মাসুম ধরা পড়ে বগুড়ায়। তত্বাবধায়ক সরকারের পর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গী বিরোধী ব্যাপক অভিযান শুরু করা হয়। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা পর জঙ্গীরা দেশের বাইরে তাদের ঘাঁটি গাড়ার পরিকল্পনা করে। জেলে বসেই ভারতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে মাসুম ওরফে সাজিদ। জামিনে মুক্ত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ২০১২ সালে সে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে। রাজশাহী দিয়ে পশ্বিমবঙ্গে ঢুকে মুর্শিদাবাদের লালগোলায় মকিমনগরের মাদ্রাসায় ডেরা বাঁধে সে। পশ্চিমবঙ্গের সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব পাওয়ার পর পদ্মার বুকে আষাঢ়িয়াদহের চরেও কয়েকটি ঘাঁটি বানায়। অস্ত্র, মাদক, জাল নোটের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করত মাসুম। কওসর নামের এক জামায়াতী নেতা ছিল তার অন্যতম সহযোগী। কওসর এখনও পলাতক। সাজিদ বলেছে, প্রাণ বাঁচাতে চলে আসি ॥ গ্রেফতারের পর কলকাতার নগর দায়রা জজ আদালতের মুখ্য বিচারক মুমতাজ খানের এজলাসে তোলার পর সাজিদ বলেছে, আমি বাংলাদেশে অপরাধী ছিলাম। বাঁচার জন্য এখানে এসেছি। আমি ভারতীয় হিসাবে থাকতে চাই। বিচারক তার বক্তব্য জানতে চাইলে এ কথা জানায় সাজিদ। সে জানায়, বাংলাদেশ থেকে শাহিদা নামের এক নারী জঙ্গী তাকে নির্দেশ দিত। বর্ধমান খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের সংগঠন জেএমবির প্রধান হোতা সজিবকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষণা করার পর ধরা পড়লে তাকে আদালতে তোলা হয়। বীরভূমের বাসিন্দা বুরহান শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই নামে প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে নিজের ছবি জুড়ে দেয়। সাজিদ নিজে কোন ফোন ব্যাবহার করত না। তার সঙ্গে থাকত চার-পাঁচ জন। তাদের ফোনই ব্যবহার করত সে। বিধাননগর কমিশনারেটের সন্ত্রাস দমন দল শনিবার বিমানবন্দর এলাকায় বাহক মারফত টাকা নেয়ার টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলে গ্রেফতার করে সাজিদকে। সুজেনা মেঘালয়ে পালাচ্ছিল ॥ জেএমবির নারী জঙ্গী নেত্রী সুজেনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের পর পালিয়ে এসেছিল অসমের গুয়াহাটিতে। পালিয়ে মেঘালয়ে যাওয়ার পথে গুয়াহাটি বাস স্ট্যান্ড এলাকায় গ্রেফতার হয়। তার স্বামী পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী নেতা শাহনুর আলম ডাক্তার তাকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে যায়। গুয়াহাটি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ধরা পড়ার সুজেনাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জেরা করা হলে সে এতই অনঢ় ও শক্ত যে প্রতিটি জেরার জবাবে বলে, ‘জানি না’।
×