ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২

ডাক্তার সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত নাঙ্গলকোট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ভোগান্তিতে রোগীরা

বেলাল হোসেন রিয়াজ, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ১৯:৩০, ২৮ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৯:৩১, ২৮ জুলাই ২০২৫

ডাক্তার সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত নাঙ্গলকোট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ভোগান্তিতে রোগীরা

ছবিঃ সংগৃহীত

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার সংকট থাকায় চিকিৎসা নিতে এসে প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। অথচ এই সংকট সমাধানে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. বেলায়েত হোসেনের উদাসীনতায় চরম বিশৃঙ্খলায় ভুগছে পুরো হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে সকাল থেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন রোগীরা। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তারা চিকিৎসকের দেখা পান না। ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, নার্সদের সেবাও সীমিত। ফলে চিকিৎসার জন্য আশ্রয় নিতে হচ্ছে বাইরের ক্লিনিক ও হাসপাতালে, যেখানে খরচ বহুগুণ বেশি। স্থানীয়রা জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চারপাশে রয়েছে বড় বড় আগাছা ও জঙ্গল, যা একদিকে মশাবাহিত রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে তৈরি করছে সাপ-বিচ্ছুর ভয়। হাসপাতালের ভেতরেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই বললেই চলে। বাথরুমগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী, বিভিন্ন স্থানে জমে আছে ময়লা পানি। মৌকরা ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের মোনোয়ারা নামে স্থানীয় এক রোগীর স্বজন বলেন, “সকাল ৯টায় আসছি, দুপুর গড়িয়ে গেলেও কোনো ডাক্তার আসে নাই। এমন পরিস্থিতি রোজ।”

সেবা প্রার্থী একজন বলেন, “আমি বাচ্চা নিয়ে সকাল ১০টায় আসছি, লাইনে দাঁড়িয়ে আছি ২ ঘণ্টা ধরে কিন্তু এখনো টিকিট পাইনি।”

হাসপাতালের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রোগীবহনকারী একমাত্র নতুন অ্যাম্বুলেন্সটি দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। অথচ এটি জরুরি সেবার জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল।

জানা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সটির সামান্য যান্ত্রিক সমস্যা থাকলেও তা মেরামতের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি একাধিকবার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বেলায়েত হোসেনকে জানানো হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।

রোগীদের স্বজনরা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে যখন অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন হয়, তখন সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ‘নষ্ট’ বলে জানানো হয়। কিন্তু হাসপাতাল চত্বরে অনেকগুলো প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

জরুরি মুহূর্তে রোগী পরিবহনের সুযোগ থাকলেও, তা কাজে লাগানো হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে। স্থানীয়দের অভিযোগ, হাসপাতালের একমাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্সটি মেরামত না করে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখিয়ে তা সাধারণ রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না। বরং সিন্ডিকেটভুক্ত প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বেলায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে কড়া সমালোচনা করেছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মোঃ আনোয়ার হোসেন নয়ন (ছোট নয়ন)।

তিনি বলেন, “ডা. বেলায়েতের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও সেবা গ্রহীতাদের থেকে অনিয়মের অভিযোগ শুনে আসছি। তিনি নাকি একজন একঘেয়েমি, তেরা প্রকৃতির লোক। নিজের দায়িত্ব পালন না করে নিজের ইচ্ছেমতো চলেন। কারো কথায় কর্ণপাত করেন না। সময়মতো নিজ দপ্তরে আসেন না তিনি।”

মোঃ আনোয়ার হোসেন নয়ন (ছোট নয়ন) আরও অভিযোগ করে বলেন, “শুনেছি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্সটি দীর্ঘদিন ধরে একটি চাকা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। অথচ তা মেরামতের উদ্যোগ না নিয়ে বরং চালককে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতীতে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সময়মতো রোগী পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না।”

নাঙ্গলকোট হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক শাফায়েত বলেন, “কিছুদিন আগে গাড়ির একটি চাকা নষ্ট হয়। আমি স্যারকে (স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) বারবার বলেছি ঠিক করতে। কিন্তু তিনি বলেন, গাড়ি রেখে বাড়ি চলে যেতে। তাই আমি এখন বাড়িতেই আছি। অ্যাম্বুলেন্সটা নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে অনেকদিন।”

এছাড়াও, হাসপাতালের ডাক্তারদের সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ডিউটি করার বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় ডাক্তার আসে ১০টার পরে। এমনকি ১টার আগেই অনেক ডাক্তার চেম্বার ত্যাগ করে।
এছাড়াও কাগজে-কলমে পর্যাপ্ত ডাক্তার থাকলেও বাস্তবে হাসপাতালে অনেক ডাক্তার নেই, প্রায়ই দেখা যায় উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার দ্বারা চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়।

এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়মিত তদারকির অভাব, পর্যাপ্ত ওষুধের সংকট এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

স্থানীয় সুশীল সমাজ মনে করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অবহেলাই এই সংকটের মূল কারণ। তারা দ্রুত ডা. বেলায়েত হোসেনকে প্রত্যাহার ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বেলায়েত হোসেনের কাছে গেলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দেখা করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। পরে তার ব্যবহৃত সরকারি নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. আলী নুর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ বলেন, “স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বেলায়েত হোসেনের ব্যাপারে আগেও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। সে সকল বিষয়ে ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ রুবাইয়াত বিন করিমকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে এবং তদন্ত চলমান আছে। তাই আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না, এখন আপনার মাধ্যমে জানলাম। বিষয়টি অবশ্যই দেখব।”

চিকিৎসার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দক্ষ ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও কার্যকর অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিশ্চিত করা জরুরি।

ইমরান

×