
বিশ্ব যখন প্রযুক্তি ও মানবাধিকার উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন চীনের শিনজিয়াং অঞ্চলে ঘটে চলেছে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দমননীতি। লক্ষ লক্ষ উইঘুর মুসলিম ধর্মীয় স্বাধীনতা, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছু হারিয়ে পড়েছে এক কঠোর রাষ্ট্রীয় নীতির নিঃশ্বাসরুদ্ধ পরিবেশে। এই অঞ্চল যেন আজ একটি খোলা কারাগার, যেখানে প্রতিটি দিন নিঃশব্দে দগ্ধ হচ্ছে একটি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব।
শিনজিয়াং, যাকে পূর্ব তুর্কিস্তানও বলা হয়, একসময় মধ্য এশিয়ার ইসলামী সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। সপ্তম শতকে পারস্য ও আরব বণিকদের হাত ধরে ইসলাম প্রবেশ করে এই অঞ্চলে। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর দূতের মাধ্যমে ইসলাম এখানে প্রতিষ্ঠা পায়। শত শত মসজিদ, মাদরাসা ও মুসলিম সংস্কৃতির চিহ্ন সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করলেও, আজ সেসব ধ্বংসের মুখে।
চীনের কমিউনিস্ট শাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই উইঘুরদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে পরিকল্পিতভাবে দমন করা শুরু হয়। ১৯৩০-এর দশকে স্বল্পকালীন ‘পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র’ গঠনের চেষ্টা করলেও তা চীনা ও সোভিয়েত হস্তক্ষেপে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট চীন প্রতিষ্ঠার পর থেকে দমন-পীড়ন আরও তীব্র হয়।
বিশেষ করে ২০০৯ সালে উরুমকিতে সংঘটিত দাঙ্গার পর সরকার উইঘুরদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদ’ দমন অভিযানের নামে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরপর ২০১৪ সালে চালু হয় তথাকথিত ‘পুনঃশিক্ষা শিবির’, যা আদতে এক ধরনের গণ-আটক কেন্দ্র। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এসব শিবিরে অন্তত ১০ থেকে ২০ লাখ উইঘুর মুসলমানকে আটক রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ধর্ম পরিত্যাগে বাধ্য করা, কোরআন পাঠ ও নামাজ নিষিদ্ধ, জোর করে চীনা ভাষা শেখানো এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য স্বীকার এসবই সেখানে দৈনন্দিন বাস্তবতা।
শুধু মন নয়, উইঘুর নারীদের শরীরও দখল করেছে চীন সরকার। জোর করে বন্ধ্যাত্বকরণ, গর্ভপাত ও গর্ভনিরোধক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। গবেষক আদ্রিয়ান জেনজের মতে, এই পরিকল্পনার ফলে উইঘুরদের ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে।
এছাড়া হাজার হাজার মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে, হিজাব ও দাড়ি নিষিদ্ধ, রোজা রাখা ও ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি কোরআন পোড়ানোর অভিযোগও উঠেছে। পুরো অঞ্চল পরিণত হয়েছে নজরদারির রাজ্যে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতিটি নাগরিকের ওপর চলছে কড়া নজরদারি। বন্দিশিবির থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের বাধ্য করা হচ্ছে জোরপূর্বক শ্রমে অংশ নিতে, যাকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘দাসশ্রম’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
চীনের এসব কর্মকাণ্ডকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি সহ অনেক দেশ ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ জানায়, কমপক্ষে ১০ লাখ উইঘুর মুসলমান বন্দি রয়েছেন। তবে চীনের পক্ষ নিয়ে জাতিসংঘে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি আরব, পাকিস্তান, রাশিয়া সহ ৩৬টি দেশ। এসব দেশের সঙ্গে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসহ নানা অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে তারা চুপ থাকছে কিংবা সমর্থন জানাচ্ছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, চীনে আরেকটি মুসলিম গোষ্ঠী ‘হুইরা’ তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা পায় কারণ তারা ম্যান্ডারিন ভাষাভাষী এবং হান চীনা সংস্কৃতির সঙ্গে সহজে মিশে যায়। ফলে তারা মসজিদ নির্মাণ বা রোজা রাখার ক্ষেত্রে বাধা পান না।
শিনজিয়াংয়ে যা হচ্ছে তা শুধু একটি জাতি বা ধর্মের বিরুদ্ধে দমন নয় এটি মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সভ্যতার বিরুদ্ধে এক মরণঘাতী যুদ্ধ। বিশ্ব যতদিন এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সৎভাবে রুখে না দাঁড়াবে, ততদিন নিঃশব্দে ধ্বংস হবে আরও অনেক ইতিহাস, আরও অনেক সংস্কৃতি, আরও অনেক জীবন।
Jahan