
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বুড়ি তিস্তা নদীকে বালুমহাল ঘোষণা করে বালু উত্তোলনের ফলে স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য এবং কোটি টাকায় নির্মিত নদী রক্ষা বাঁধ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বালুবাহী ড্রাম ট্রাকের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও ভারী শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে এলাকায় দেখা দিয়েছে নতুন করে প্লাবনের শঙ্কা, যা এলাকাবাসীর মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
জানা যায়, জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা এলাকার বুড়ি তিস্তার পাড়ঘাট এলাকার ভাটিতে ড্রেজার মেশিন ও ভারী শ্যালো ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ ঘনফুট বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, নদীর গতিপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং ইকো-সিস্টেমে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বিশেষ করে, কোটি টাকায় নির্মিত বুড়ি তিস্তার উভয় তীরের বাঁধ বালুবাহী ড্রাম ট্রাকের ভারে দেবে গিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধের কার্যকারিতা হুমকির মুখে পড়ায় বর্ষা মৌসুমে এলাকার লক্ষাধিক মানুষ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন অর্ধ সহস্রাধিক ট্রাকে করে নদীর বামতীর ও ডানতীর উভয় বাঁধ দিয়ে বালু পরিবহন করা হচ্ছে। প্রতিটি ট্রাক থেকে ৩ হাজার টাকায় বালু বিক্রি হচ্ছে এবং একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা বিভিন্নজনের পকেটে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
প্রবহমান নদীকে বালুমহাল ঘোষণা করে বালু উত্তোলনে জেলা প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক পরিবেশবিদসহ জেলাবাসী। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল নিলামের মাধ্যমে বালুমহাল ইজারা নিয়েছে বলে দাবি করলেও, তারা এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। কতিপয় ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় জেলা প্রশাসন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যার মাশুল গুনছে বুড়ি তিস্তা নদী অববাহিকার মানুষ এবং সরকারের শত শত কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিয়ম না মেনে বাঁধের ওপর দিয়ে নিয়মিত ভারী ট্রাক চলাচলের অনুমতি দেওয়ায় এই বিপর্যয় ঘটেছে। বাঁধটি নির্মাণের সময় থেকেই এলাকাবাসী সেখানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে এলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে।
বাঁধ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আলিম উদ্দিন হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, "বাঁধটা বানানো হয়েছিল আমাদের ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য। কিন্তু এখন দেখছি এই বাঁধই ভেঙে আমাদের ডুবাবে।" একই এলাকার গৃহবধূ শিরিনা বেগম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, "ট্রাকগুলো রাত-দিন চলছে। আমরা অনেকবার বলেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি। এখন ভোগান্তিটা আমাদের।"
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নীলফামারী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম জানান, এই বাঁধ মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য। এখানে যানবাহন চলাচলের কোনো অনুমোদন ছিল না। কে বা কারা এটি ব্যবহার করেছে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জ্যোতি বিকাশ জানিয়েছেন, বাঁধটি পরিদর্শন করে দ্রুত মেরামতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি দোষীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
এলাকাবাসীর মতে, বাঁধটি রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। দ্রুত মেরামত না হলে বর্ষায় পুরো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বাঁধে স্থায়ীভাবে ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নজরদারির জন্য সিসি ক্যামেরা বসানোর দাবি জানিয়েছেন।
সচেতন মহল মনে করছে, এই ঘটনা শুধু অবকাঠামোগত ক্ষতির চিত্র নয়, বরং স্থানীয় প্রশাসন, প্রকৌশল বিভাগ ও সচেতন মহলের কাছে এটি এক সতর্ক সংকেত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার ওপর। অন্যথায় বর্ষা মৌসুমে এর চরম মাশুল দিতে হতে পারে এলাকাবাসীকে।
Jahan