ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

শিক্ষার্থীদেরকে জীবন দিলেন, নিজে ফিরে এলেন কফিনে—নীলফামারীর মেয়ে মেহরিন

তাহমিন হক ববি, নীলফামারী

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ২২ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৮:০৮, ২২ জুলাই ২০২৫

শিক্ষার্থীদেরকে জীবন দিলেন, নিজে ফিরে এলেন কফিনে—নীলফামারীর মেয়ে মেহরিন

ছবি: শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরী

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ২০ শিক্ষার্থীকে প্রাণে বাঁচিয়ে নিজেই চিরবিদায় নিলেন বীর শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরী। তিনি ছিলেন নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামের মেয়ে। আজ সেই গ্রামে শোকের মাতম।

এলাকাবাসীরা জানান, মেহরিনের বাবা মরহুম মুহিত চৌধুরী। মেহরিন রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ছিলেন। সম্প্রতি তিনি নিজ গ্রামের বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজকে মাইলস্টোনের মতো গড়ে তোলার স্বপ্নে এক মাস আগে ওই স্কুলের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমনটাই জানিয়েছেন তার স্বামী মনসুর হেলাল। স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি শোকে পাথর। তিনি বলেন, মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাদ জোহর দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে গ্রামের বাড়ি জলঢাকার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়ায় বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।

শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর—এই কথার সত্যতা যেন নিজ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন মেহরিন চৌধুরী। সোমবার (২১ জুলাই) প্রতিদিনের মতো স্কুল শেষ করে শিশুদের হাতে ধরে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছিলেন তিনি। সেই সময় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় এবং মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দগ্ধ হন মেহরিন। কিন্তু তখনো তিনি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিলেন।

পরে তাকে দগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়া হয়। রাত সাড়ে সাতটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বার্ন ইউনিট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

মেহরিন চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভরা স্ট্যাটাস।
নীলফামারী জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মারুফ পারভেজ প্রিন্স লিখেছেন— “৮০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়েও নিজের সন্তানের মতো শিক্ষার্থীদের ছেড়ে যাননি তিনি। বরং ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ বাঁচানোর উছিলা হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের নীলফামারীর সাহসী মেয়ে… আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন আল্লাহ।”

একজন শিক্ষার্থী অর্পিতা বিনতে জামান লেখেন— “আমাদের নীলফামারীর গর্ব মেহরিন চৌধুরী। অন্তত ২০ শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়ে নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মহান সৃষ্টিকর্তা উনাকে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।”

আরও একজন নীলফামারীর তরুণ ইনজামাম-উল-হক নির্ণয় বলেন— “কঠিন মুহূর্তেও শিক্ষিকার দায়িত্ব ভুলেননি তিনি। দগ্ধ শরীর নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এমন আত্মত্যাগ ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার পরপরই ক্লাসরুম থেকে শিক্ষার্থীদের দ্রুত বের করে দেন মেহরিন। এক সেনা সদস্য বলেন, “ম্যাডাম ভিতরে ঢুকে গিয়ে বাচ্চাগুলারে বের করে দিছেন, তারপর উনিই আর বের হতে পারেন নাই।”

উদ্ধার হওয়া শিক্ষার্থী ছোয়ার বাবা সুমন বলেন, “ম্যাডাম না থাকলে আমাদের ছোয়া বাঁচত না।”

ছোয়ার মামা জানান, “আমি খালি ওর চুল পড়ে থাকতে দেখেছি, পরে জানতে পারি এক ম্যাডাম ওকে বের করে আনেন।”

একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছে— “ম্যাডাম বলছিলেন, ‘দৌড়াও, ভয় পেও না, আমি আছি।’”

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, শিক্ষিকা মেহরিনের সাহসিকতায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা সম্ভব হয়েছে। মানবিকতা, সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি।

নুসরাত

×