
২০ জুলাই, ঠিক এক বছর আগে এই দিনেই পুলিশের ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারান গলাচিপার আমখোলা ইউনিয়নের সন্তান সিএনজি চালক জাহাঙ্গীর খান (৪০)। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকার দনিয়া যাত্রাবাড়ীর ছনটেক এলাকায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর সেদিন রাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন তার লাশ গলাচিপায় নিজ গ্রামে দাফন করা হয়।
জাহাঙ্গীর আমখোলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাউরিয়া এলাকার মৃত রত্তন আলী খানের ছেলে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া জাহাঙ্গীর যুবক বয়সে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমায় ঢাকায়। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত সিএনজি চালকের কাজটি বেছে নেয়। ব্যক্তিগত জীবনে জাহাঙ্গীর হোসেন পাঁচ সন্তানের জনক। প্রথম স্ত্রী মৃত্যুর পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মমতাজ বেগমের সঙ্গে। সবকিছু ভালোভাবে চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করে কোটা আন্দোলন ও একটি গুলি সবকিছু এলোমেলো করে দেয়।
এক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সময় থেমে আছে তার পরিবারের। থমকে আছে পাঁচ সন্তানের ভবিষ্যৎ, স্ত্রীর চোখের জল আর মুছে যায়নি গেঞ্জিতে লেগে থাকা সেই রক্তের দাগ।
"শিঙারা আনতে গিয়ে বাবাকে হারালাম"
স্মৃতিচারণে জাহাঙ্গীরের ছেলে রবিউল ইসলাম বলেন, "২০ জুলাই দুপুরে ছোট ভাই শিঙারা খেতে চাইলে আমি আর বাবা নিচে ছনটেক গলির দোকানে যাই। সেদিন কারফিউ চলছিল আর রাস্তায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল। আমরা শিঙারা নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ পুলিশ গলির মধ্যে গুলি ছোড়া শুরু করে। সবাই দৌড়াচ্ছিল, আমি আর বাবা গলির মধ্যে আটকে পড়ি। এ সময় বাবার মাথায় গুলি লাগে, তিনি রাস্তায় পড়েছিলেন—আমি রক্তমাখা গেঞ্জি দেখে তাকে চিনতে পারি। পুলিশ চলে গেলে আমি চিৎকার দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরি। অনেক কষ্টে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার আগেই তিনি অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন।"
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, "আমার স্বামীই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম। সে আজ নেই আমরা আর কীভাবে বাঁচবো? আমি ঢাকায় বাসায় কাজ করি, বড় ছেলে একটা কোম্পানিতে সামান্য চাকরি করে। এক মেয়ে এবার এসএসসি দিল, দুই ছেলে এখনো স্কুলে পড়ে। আড়াই বছরের একটা মেয়ে আমার কোলে।"
এদিকে জাহাঙ্গীরের রয়েছে আগের স্ত্রীর ঘরের আরও তিন সন্তান দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তারা গলাচিপার আমখোলায় থাকেন। বড় ছেলে ও মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওরাও ভালো নেই, আমরা কেউই ভালো নেই। "আমরা সরকারকে অনুরোধ করি আমাদের পাশে দাঁড়ান। শুনেছি সরকার সহায়তা করবে, এখনো আশায় আছি" বলেন রবিউল।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিহত সাধারণ মানুষের সংখ্যা আজও নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। কিন্তু তাদের পরিবারগুলো আজও বাঁচার লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সঙ্গে একটি পরিবার, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎকেও থামিয়ে দিয়েছে। আজ এক বছর পরেও যখন জাহাঙ্গীরের ছেলেমেয়েরা সাহায্যের অপেক্ষায় থাকে, তখন জুলাই-আগস্টের আন্দোলন যে কত মানুষের জীবনে শূন্যতা এনেছে তার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শহীদ জাহাঙ্গীরের মতো অসংখ্য পরিবার।
আফরোজা