ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

সবার মৃত্যু তো আর শহীদি মৃত্যু হয় না; যেটা আমার স্বামীর হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ১৮ জুলাই ২০২৫

সবার মৃত্যু তো আর শহীদি মৃত্যু হয় না; যেটা আমার স্বামীর হয়েছে

ছবি : শহিদ আল আমিন রনি ও তার স্ত্রী এবং সন্তান

“আমার স্বামী কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তবে কাজের ফাঁকে বন্ধুদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে তিনি শহীদ হয়েছেন। প্রথমদিকে আমার স্বামীর অনুপস্থিতি আমাকে অনেক পীড়া দিত।

তবে এখন নিজেকে বুঝাই—সবার মৃত্যু তো আর শহীদি মৃত্যু হয় না; যেটা আমার স্বামীর হয়েছে। আমি চাই শহীদের স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে, আর এটাই আমার শক্তি।”

কথাগুলো বলছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে (২০২৪ সালের ১৯ জুলাই) নির্মম বুলেটে শহীদ হওয়া আল-আমিন রনির স্ত্রী মীম আক্তার।

রনির মৃত্যুর সময় তার স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তান মিথিলা ইসলাম রোজার আজ আট মাস বয়স হয়েছে। সে আধো আধো বুলিতে প্রায়ই “বাবা, বাবা” বলে ডেকে ওঠে। কিন্তু তার সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার কেউ নেই।

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামের বাসিন্দা মৃত দুলাল হাওলাদারের স্ত্রী মেরিনা বেগম তার বড় ছেলে রনি ও ছোট ছেলে রহিমকে নিয়ে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বাউন্ডারি বস্তিতে বসবাস করে আসছিলেন।

দিনের বেলায় রনি রাজধানী ঢাকার মহাখালীর একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাতের বেলায় অনলাইনে খাবার বিক্রি করা একটি প্রতিষ্ঠানের খাবার সরবরাহের কাজ করতেন। দিনে-রাতে এভাবে কাজ করে, এ কে ফজলুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা রনি, বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেন।

২০২৩ সালে বানারীপাড়ার চাখার গ্রামের বাসিন্দা কামাল হোসেন মাঝির মেয়ে মীম আক্তারকে সামাজিকভাবে বিয়ে করেন রনি। বিয়ের কয়েক মাস পর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় মীম তার বাবার বাড়িতে চলে আসেন।

গত বছরের ১৯ জুলাই দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে মহাখালীতে অবস্থানকালে রনি বাম পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। ওইদিন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরেরদিন ২০ জুলাই রনিকে বানারীপাড়ায় এনে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। রনির মৃত্যুতে তাদের পুরো পরিবারটি তছনছ হয়ে যায়। পৃথিবীতে আসার আগেই বাবাকে হারায় রোজা। স্বামী হারা হন মীম আক্তার। আর উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়েছেন রনির বিধবা মা মেরিনা বেগম।

বর্তমানে ছোট্ট রোজা তার মায়ের সাথে বানারীপাড়ার চাখারে নানাবাড়িতে থাকে। আর রোজার দাদি মেরিনা বেগম একাই থাকেন বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামের স্বামীর ভিটায়। শহীদ রনির ছোট ভাই এখন সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় থেকে ভাইয়ের ওয়ার্কশপেই চাকরি করছেন।

শহীদ রনির স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, “আমার স্বামীর মৃত্যুর সময় রোজা আমার গর্ভে। মৃত্যুর আগে আমাদের সন্তানের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন—মিথিলা ইসলাম রোজা। আজ আমাদের সন্তান ‘বাবা’ ডাকটি বলতে পারলেও, ওর বাবা তো আর আসে না! এই দুঃখ আমি কাকে বলব, ওকে কীভাবে বলব ওর বাবা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।”

নাতনী রোজার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়ে মীম আক্তারের জন্য সরকারি একটি চাকরির দাবি জানিয়ে শহীদ রনির শ্বশুর, ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী কামাল হোসেন মাঝি বলেন, “আমার মেয়ে যখন গর্ভবতী তখনই আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। মীম আমাদের প্রথম সন্তান, তাই মেয়ের সেবাযত্ন আমরাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আর মেয়েকে তার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে দেয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “রনির মৃত্যুর পর আমার মেয়ে অনেকটা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। তারপরেও নাতনী রোজার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আবার শক্ত হয়েছে। মেয়ের ইচ্ছাতেই তাকে চাখারের এ কে ফজলুল হক কলেজে অনার্সে ভর্তি করেছি।”

শহীদ রনির স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, “জুলাই ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি সরকারিভাবেও তারা সহায়তা পেয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা সমান দুই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অর্ধেক আমি আর আমার মেয়ে পাচ্ছি, আর বাকি অর্ধেক আমার শাশুড়ি পেয়েছেন। আর সরকারিভাবে ১০ লাখ টাকার যে সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে মুনাফাও আমরা একইভাবে ভাগ করে নিচ্ছি। প্রতি মাসে শাশুড়ি আমাদের বাড়িতে আসেন, নাতনীর খোঁজখবর নেন। আমার স্বামী যে ওয়ার্কশপে কাজ করতেন সেই ওয়ার্কশপের মালিক আমার দেবরকে চাকরি দিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “সময় যত যাবে আমাদের সন্তান বড় হবে, ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজে আবার পড়াশোনা শুরু করেছি। একটা চাকরিও খুঁজছি। কারণ এখন যে মুনাফার টাকা হাতে আসে, তা দিয়ে চলা কষ্টকর। চাকরি হলে মা-মেয়ের জীবনধারণ কিছুটা সহজ হবে।”

সানজানা

আরো পড়ুন  

×