
ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ।
৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যয়ে বাস্তবায়িত ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প এখন দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রার ভবিষ্যতকে নিয়ে এসেছে গভীর অনিশ্চয়তায়। বছর না যেতেই বন্দরের চ্যানেলের গভীরতা প্রায় আগের অবস্থায় ফিরে আসায় বড় জাহাজ ভিড়ছে না বন্দরে, কার্যকারিতাও হারাচ্ছে পুরো প্রকল্প।
২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে পায়রা বন্দর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঘোষিত সমুদ্রবন্দর হলেও, শুরু থেকেই বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল—চ্যানেলের পর্যাপ্ত নাব্যতা। প্রাকৃতিকভাবে এর গভীরতা ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৩ মিটার। এই সমস্যা সমাধানে গভীরতা বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫ মিটার করার লক্ষ্যে নেওয়া হয় ব্যয়বহুল ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নের এক বছরের মধ্যেই চ্যানেলের গভীরতা নেমে এসেছে মাত্র ৬ দশমিক ৫ মিটারে। ফলে ৪০ হাজার ডেডওয়েট টন ধারণক্ষমতার ‘মাদার ভ্যাসেল’ নয়, এখন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার কয়লাবাহী জাহাজই ভিড়ছে পায়রা বন্দরে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এই ড্রেজিং ছিল দুর্বল পরিকল্পনা ও নিম্নমানের বাস্তবায়নের ফল। পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কামল হোসেন বলেন, “ড্রেজিং হয়নি পরিকল্পনা অনুযায়ী, বরং হয়েছে দুর্নীতি ও অপচয়।” একই অভিযোগ করেন পটুয়াখালী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আন নাহিয়ানও।
এ বিষয়ে পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাসুদ ইকবাল স্বীকার করেন, “চ্যানেল চালু রেখে ড্রেজিং না করাটা ছিল বড় ভুল।” তার মতে, “প্রকল্প পুরোপুরি ব্যর্থ নয়, আবার সম্পূর্ণ সফলও বলা যাবে না।”
বন্দরের পক্ষ থেকে ড্রেজিং শেষে ১০ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার দাবি করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। কারণ মূল টার্মিনালের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি, ফলে চ্যানেলে জাহাজ প্রবেশ করলেও তা জেটিতে ভিড়তে পারছে না। বাধ্য হয়ে লাইটারেজ জাহাজে মাল খালাস করতে হচ্ছে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিক ড্রেজিং না থাকায় এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বিশাল বাজেটের প্রকল্প হলেও দেশ তার পূর্ণ সুফল পায়নি।
তবে আশাহত নন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, “পায়রা বন্দরের ভৌগোলিক অবস্থান খুবই সম্ভাবনাময়। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা হলে এটি বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।” একই অভিমত ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিজানুর রহমানেরও।
পায়রা বন্দরে এখন পর্যন্ত ৫২৯টি বিদেশি এবং ৩ হাজার ৪২৬টি দেশীয় লাইটারেজ জাহাজ পণ্য খালাস করেছে। সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। বিপরীতে শুধু ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পেই খরচ হয়েছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এই বৈষম্য থেকেই প্রশ্ন উঠছে—এত বিপুল ব্যয়ের পরও কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার দায় কার? ভবিষ্যতে পায়রা বন্দরের কার্যকারিতা বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে?
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পায়রাকে কার্যকর সমুদ্রবন্দরে রূপ দিতে হলে এখনই প্রয়োজন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, দীর্ঘমেয়াদি ড্রেজিং পরিকল্পনা এবং সর্বোপরি—ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তাহলে একদিন পায়রা বন্দরও দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম কিংবা মোংলার মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবে।
মিরাজ খান