
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ৮ জুলাইও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ৮ জুলাইও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, রাস্তা অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলনে কোনো সুরাহ না পেয়ে দীর্ঘমেয়াদে আন্দোলনের প্রস্তুতির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ মেয়াদের এই আন্দোলন সফল করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ৬৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন তারা।
এদিন দ্বিতীয় দিনের অবরোধ কর্মসূচির পর রাতে দাবি আদায়ে সরকারকে তিনদিনের আল্টিমেটাম দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে আগামী তিনদিন দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি সারাদেশে গণসংযোগ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করবেন বলেও জানান তারা। আগের দিনের মতো এই দিনও দুপুরের পর থেকে রাজধানীর শাহবাগসহ বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের একটিই দাবি ‘কোটা প্রথা বাতিল চাই, কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না তারা। ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিষয়টি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের বক্তব্যে ছাত্র-জনতা আরও ফুঁসে ওঠে। তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন হওয়ায় তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করা উচিত না।
এর আগে চার দফা দাবিতে আগেরদিন সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্ট অবরোধ করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন তারা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চতুর্থ দিনের মতো রাজধানীর শাহবাগে বিকেল পৌনে পাঁচটা থেকে পৌনে ৬টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা অবস্থান করেন।
শিক্ষার্থীদের মিছিলটি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ভিসি চত্বর, টিএসসি, জগন্নাথ হলের মোড় হয়ে বকশিবাজার, বুয়েট, পলাশী মোড় হয়ে ইডেন কলেজ, হোম ইকোনমিক্স, নীলক্ষেত থেকে পুনরায় রাজু ভাস্কর্য হয়ে শাহবাগ গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে শিক্ষার্থীদের কোটা না মেধা, মেধা মেধা; কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক; আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই; আপোস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম; হাইকোর্ট না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ; দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ ইত্যাদি স্লোগান দেন ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
ওই সময় শাহবাগে সমাবেশে কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুনেছি, হলে হলে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নিতে বাঁধা দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, আমরা হলের তালা ভাঙতে জানি। ২০১৮ সালে আমরা তা দেখিয়েছি। এই আন্দোলন সারাবাংলার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ইতোমধ্যে তা প্রমাণ করেছে। আমরা সুযোগের সমতা চাই। আমরা চাকরিতে সমতা চাই। এটা কি আমাদের অপরাধ ?
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মাঠে থাকতে হবে।’ অভিভাবকদের প্রতি ও শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে নাহিদ বলেছিলেন, আপনারা শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। আপনার সন্তানদের কথা চিন্তা করে এই আন্দোলনে আসুন। নইলে কিছুদিন পর আপনার সন্তানরাও চাকরি পাবে না।’
হরতালের হুঁশিয়ারি দিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা দুই-তিন দিন রাস্তা অবরোধ করে ঘরে ফিরে যাব, সরকারের এই ধারণা ভুল। আমরা এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। প্রয়োজনে আমরা সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।’
কোটা আন্দোলনে যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসাইনকে ‘বিতর্কিত কর্মকা-ের’ সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে অব্যাহতি দেন মডারেটর ও বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন। এই ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠনের ২১ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন।
সারাদেশে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ॥ ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে সায়েন্সল্যাব ও নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁতীবাজার সড়ক অবরোধ করেন। এর আগে কাঁঠালতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে পদযাত্রা ও ছাত্রসমাবেশ করেছেন। তারা রংপুর ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সিলেট সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টাঙ্গাইল সড়কের আশেকপুর বাইপাসে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুলনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে নানা অভিযোগ পাওয়া যায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে। এই আন্দোলনকে তারা বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর একটি ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন। এতে আরও ফুঁসে ওঠে আন্দোলনকারীরা। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলও করেন তারা।
প্যানেল হু