
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশ তত পিছিয়ে যাবে। বিনিয়োগ আসবে না, মায়েরা-মেয়েরা নিরাপত্তা হারাবে, জুডিশিয়াল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সেই জন্য দরকার একটা নির্বাচিত সরকার। যেই সরকারের পেছনে রয়েছে জনগণ।’ নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে মানুষের কাছে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেন। মানুষের কাছে যান। মানুষ যাতে বুঝতে পারে বিএনপি ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নাই।’
সোমবার ৭ জুলাই দুপুরে সিলেট নগরীর পাঠানটুলা এলাকাস্থ সানরাইজ কমিউনিটি সেন্টারে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক আয়োজিত বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি ও তারেক রহমানের দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘তিনি লন্ডনে তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের সময় ঠিক করেছেন, এই জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।’
বক্তব্যের শুরুতে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যখন সুযোগ পাই সিলেট আসি। কারণ হচ্ছে, শত শত বছর পূর্বে এখানে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। সত্য, সুন্দর ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.) দরগায় আমরা আসি। আমি নয়, আমরা, নিই—সারা দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন। কারণ তারা এই মহান পুরুষরা যারা অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য মানুষকে আলোকপাত করেছিলেন, সেই মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা জানাতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের পুণ্যভূমি। সিলেট আমাদের কাছে আরো প্রিয় আরেকটা কারণ আছে, তা হচ্ছে আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেবের শ্বশুরবাড়ি। সেই জন্য আমরা এখানে আসতে আনন্দ পাই, শান্তি পাই।’
এ সময় তিনি ইলিয়াস আলীসহ সকল গুম হওয়া নেতাদের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘এমনি এমনি হঠাৎ করে হাসিনা পালায় নাই, বহু মানুষের সংগ্রাম, রক্ত, ত্যাগ মিলিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত হলাম। আমরা তো লড়াই করেছি গণতন্ত্রের জন্য। আমরা একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কথা বলতে পারবে, বাকস্বাধীনতা থাকবে, মহিলারা নিরাপত্তা পাবে, তরুণরা কাজের সুযোগ পাবে, মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাবে—এমন একটা দেশ আমরা চাই। সেই দেশ তৈরির জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করেছি। আর আমাদের এই সংগ্রামের নেতা হচ্ছেন তারেক রহমান। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখনো অসুস্থ অবস্থায় আমাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসিনা গণতন্ত্র, ভোট, পত্রিকা বন্ধ করেছিল। মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিল। সেই অবস্থায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র এনে নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন।’ আমরা সেই দল, যে দল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চাই এবং বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্র করতে চাই। সেজন্য বিএনপি ৩১ দফা দিয়েছে। শহীদ জিয়াউর রহমান যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই দেশ আমরা গড়তে চাই। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কেউ যাতে আঙুল তুলে না বলতে পারে আমরা জমি দখল করেছি, চাঁদাবাজি করেছি, জায়গা দখল করেছি। জয় আমাদের সুনিশ্চিত, ইনশাআল্লাহ।’
এ সময় তিনি বলেন, ‘সিলেটের যেখানে বেগম জিয়া সমাবেশ করেছিলেন সেখানে এবার তারেক রহমানকে নিয়ে দেখা হবে।’
এর আগে সোমবার সিলেট সফরে এসে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ গণতন্ত্রে ফিরবে ও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। জুলাই ও আগস্টের আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের প্রতি বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহানুভূতি জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য যে লড়াই করেছেন, সেটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার যে বৈঠক হয়েছে, সেই বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা আশাবাদী, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতি গণতন্ত্রে ফিরে যাবে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশ রাইট ট্র্যাকে উঠবে।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছর আমরা ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। আমাদের প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ১৭ শ’ নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। সেখানে সিলেটের অত্যন্ত সাহসী নেতা এম. ইলিয়াস আলীও রয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের জন্য বিএনপি অনেক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে।’ ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের আয়োজন করবে অন্তবর্তী সরকার—এমনই আশা বিএনপির। নির্বাচনের মাধ্যমেই সঠিক পথে দেশ এগুবে বলেও বিশ্বাস দলটির।
সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলে সেখানে অভ্যর্থনা জানান বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি. কে. গউছ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, কেন্দ্রীয় সদস্য আবুল কাহের শামীম, জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী এবং মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম।
কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকের আমন্ত্রণে এবং জেলা ও মহানগর বিএনপির আয়োজনে—দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় আয়োজিত দোয়া মাহফিল, কর্মী সভা এবং জুলাই শহীদদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে একদল লোক এবং নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছে। ‘আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছি, ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছি। ১৭ বছরের আন্দোলনের ফলে সরকারের পতন ঘটেছে। হাসিনা চলে গেছে। কিন্তু হাসিনার দোসররা এখনও দেশ ছাড়ে নাই। তারা এখনও ষড়যন্ত্র করছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শেখ হাসিনার লোকেরা এখনও রয়ে গেছে। একেবারে সচিবালয় থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত। তারা চাচ্ছে না বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। চাচ্ছে না দেশে গণতন্ত্র ফিরুক। আর এক শ্রেণির লোক আছে, ক্ষমতায় বসে তারা নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে। নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে।’
ভোটাধিকারের দাবিতে আবার আন্দোলনে নামার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের অনেক আমলারা যা বলছে, তাতে নির্বাচন করতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু বিএনপি জনগণকে সাথে নিয়ে নির্বাচন আদায় করে ছাড়বে। বাংলাদেশের জনগণ গত ১৭ বছর যেভাবে আন্দোলন করেছে, প্রয়োজনে ভোটাধিকারের জন্য আবার আমরা আন্দোলনে নামবো। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার জন্যও আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করে মির্জা আব্বাস বলেন, খালেদা জিয়াকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এই মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অনেকেই বলে ফুড পয়জনিং করে অসুস্থ করা হয়। এমনকি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হরণ করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তাই খালেদা জিয়ার এই অসুস্থতা স্বাভাবিক না।
পিআর পদ্ধতি কী, তা বাংলাদেশের জনগণ বোঝে না—তা উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, এখন একেক রাজনৈতিক দল একেক কথা বলছে। আবার একই দল একেক সময় একেক কথা বলছে। একবার বলছে—নির্বাচন হবে, আবার বলছে—এই অবস্থায় নির্বাচন সম্ভব না। আবার কখনো বলে—পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। এই নাম (পিআর) বাংলাদেশের লোক কখনো শুনে নাই। কাকে পিআর পদ্ধতি, তা বাংলাদেশের মানুষ শুনে নাই। যারা পিআর পদ্ধতির কথা বলছেন, তারা এই বিষয়ে জেনে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যে পদ্ধতিতে নির্বাচনে অভ্যস্ত, সেই পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনার পতনের জন্য যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মরণ করি।
তিনি বলেন, আমরা হাসিনা মুক্ত হয়েছি, কিন্তু ষড়যন্ত্র মুক্ত হইনি। বিএনপির বিরুদ্ধে সবাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আমরা দেখতে পারছি, একটি দল যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারা একেক দিন একেক কথা বলছে। কখনো বলছে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়, কখনো বলছে ভোটের পরিস্থিতি হয়নি, কখনো বলছে নির্বাচন হলে অসুবিধা নাই—কখন কী বলে, ঠিক নেই। তবে এটা বোঝা যায় যে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এখনো লুটের টাকা দিয়ে ঘোলা পানিতে শিকার করতে পারে। আমি সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই—সবাই সচেতন থাকবেন, যাতে এই উদ্দেশ্য হাসিল না হয়।
আফরোজা