ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

মানিকগঞ্জে নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে করতে হচ্ছে পাসপোর্ট 

আফ্রিদি আহাম্মেদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ 

প্রকাশিত: ২১:১৭, ৫ জুলাই ২০২৫

মানিকগঞ্জে নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে করতে হচ্ছে পাসপোর্ট 

মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করার জন্য নির্ধারিত সরকারি ফি ছাড়াও দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত(চ্যানেল ফি) ১ থেকে ৩ হাজার টাকা না দিলে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এতে এক প্রকার নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত টাকা (চ্যানেল ফি) দিয়েই পাসপোর্ট করতে হচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের সেবা গ্রহীতাদের ।

৩০ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত সরজমিনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, পাসপোর্ট কার্যালয়ের আশপাশে অন্তত ২৫-৩০টি কম্পিউটার দোকান। এসব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে একাধিক দালাল। সেবাপ্রার্থীদের নানা ভুল ধরিয়ে তাঁদের এসব দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বাড়তি টাকা নিয়ে পাসপোর্টের কাজ করে দেন দালালরা। এছাড়াও এইসব দোকানদাররাও সক্রিয়ভাবে দালালের ভূমিকা পালন করে থাকে। দালাল ছাড়াও কম্পিউটারের দোকানদারদের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফি দিয়ে পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে ভোগান্তি ছাড়াই পাসপোর্ট করতে পারে। এ পদ্ধতিটা অবশ্য ভিন্ন, পাসপোর্ট অফিসের নিচ থেকে ওপর তলা পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটা কর্মচারী ও কর্মকর্তার নিজস্ব চ্যানেল করে দেওয়া আছে। এই চ্যানেলে ব্যবহার করা হয় কোন একটি সংকেত যেমন: কমন মেইল এড্রেস, কোন একটি কোড কিংবা ফোনে ছবি তুলে পাঠালেই সেই আবেদন কোন ভোগান্তি ছাড়াই এপ্রুভ হয়ে যায় । 

সাধারণত কেউ যদি সরকারি ফি দিয়ে পাসপোর্ট করতে চায় তাহলে নানা ভেরিফিকেশন এর কাগজ ও অনেক ধরনের কাগজপত্র চাওয়া হয়। সেই কাগজপত্র না থাকলে আবেদনপত্র ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। আবার চ্যানেলের মাধ্যমে মানে অতিরিক্ত ফি দিয়ে গেলে শুধুমাত্র ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি ও চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট থাকলেই আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়। পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে থাকা সকলেই যেন জানে বিষয়টি।

এছাড়া সাধারণ আবেদনপত্র যেগুলো অতিরিক্ত ফি দেওয়া না হয় সেগুলো বেলা ১:৩০ ঘটিকা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়। আর যেগুলো অতিরিক্ত ফি দেওয়া হয় সেগুলো বিকেল ৪টা কিংবা ৫টা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়।

সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী:

৪৮ পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদী পাসপোর্ট: সাধারণ ৫,৭৫০ টাকা, জরুরি ৮,০৫০ টাকা, অতীব জরুরি ১০,৩৫০ টাকা।

৪৮ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদী : সাধারণ ৪,০৫০ টাকা, জরুরী ৬,৩২৫ টাকা, অতীব জরুরী ৮,৬২৫ টাকা ।

৬৪ পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদি: সাধারণ ৮,০৫০ টাকা, জরুরি ১০,৩৫০ টাকা, অতীব জরুরি ১৩,৮০০ টাকা।

৬৮ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদী: সাধারণ ৬,৩২৫ টাকা , জরুরী ৮,৬২৫ টাকা , অতীব জরুরী ১২,০৭৫  টাকা।

কিন্তু এসব নির্ধারিত টাকার বাইরে দালালের মাধ্যমে করলে গুণতে হচ্ছে আরও ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত।

এছাড়াও পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের কাছেও পাসপোর্ট এর আবেদন নিয়ে গিয়ে তাদের অতিরিক্ত টাকা দিলে তারা নিজ দায়িত্বে প্রথম ধাপের পাসপোর্ট এর কার্যক্রম সম্পন্ন করে দেয়।

নাম পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট অফিসের বাইরে অবস্থিত কিছু কম্পিউটারের দোকানদারদের সাথে কথা বললে তারা জানান, এমনিতে নরমালি পাসপোর্ট করলে নানা হয়রানি করে থাকে ভেতরে, চ্যানেলের মাধ্যমে করলে ১০ বছরের ৪৮ পাতার পাসপোর্ট ৭,৫০০ টাকা নিবো, একদম সব কমপ্লিট করে দেবো। অতিরিক্ত চ্যানেল ফি হিসেবে শুধুমাত্র ১৫০০ টাকা দিতে হবে। এমনিতে নরমালি করতে যান দেখেন বলবে এই কাগজ নাই,সেই কাগজ নাই। এই কাগজপত্র ব্যবস্থা করতেই আপনার ২০০০ টাকা লাগবে। এই টাকাগুলো কারনে বললে দোকানদারদের উত্তর থাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাইয়ের সাথে জড়িত। আমরা প্রত্যেকদিনের লেনদেন সন্ধ্যার পরে শেষ করে থাকি। 

দালাল ভেতরে নিয়ে যাবে না কিন্তু চ্যানেল ফি দিয়ে পাসপোর্ট করা সম্ভব কিনা? জানতে চাইলে তারা বলেন হ্যাঁ সম্ভব আমরা একটা কোড লিখে দেবো কিংবা একটা জিমেইল দিয়ে দিব যেটা দেখলেই তারা চিনে যাবে । অথবা আমরা ছবি তুলে তাদের মোবাইলে পাঠিয়ে দিব দেখবেন কেউ আটকাবে না । আবার এমন হয়ে থাকে মনে করেন অনেকদিন চ্যানেলে আবেদন যাচ্ছে না, কিংবা দিন দিন অতিরিক্ত ফি দিয়ে আবেদনের সংখ্যা কমছে । তখন আবার নিয়ম কানুন শক্তপোক্ত করে দেবে এবং প্রায় আবেদনী রিজেক্ট হবে।

পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে থাকা এসব দোকানদার ও দালালদের একটি যৌথ চক্র কাজ করে বলে জানান একাধিক ব্যক্তিবর্গ। বেশিরভাগ দোকানদার রাই দালাল হয়ে থাকে। এছাড়াও এরা সংখ্যাতে অনেক হওয়ার কারণে ভয়ে মুখ খুলে না পাসপোর্ট অফিসে সেবা নিতে আসা অনেকেই।

নাসরিন নামের একজন মহিলা জানান, কয়েক বছর আগে আমি পাসপোর্ট করেছিলাম সাধারণভাবে ১০ বছর মেয়াদের তখন আমার ১৩ হাজার টাকা লেগেছিলো।

মানিকগঞ্জের রূপসা গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী মো. রহিজ পাসপোর্ট নবায়নের জন্য গত বৃহস্পতিবার জেলা পাসপোর্ট কার্যালয়ে আসেন। তিনি জানান, ৪৮ পৃষ্ঠার জরুরি পাসপোর্ট নবায়নের সরকারি ফি ৮ হাজার ৫০ টাকা হলেও তাকে একটি দালালের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে।

কেন দালালের সাহায্য নিলেন জানতে চাইলে রহিজ বলেন, "নিজে আবেদন করতে গেলে নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। তাই বাধ্য হয়ে দালালের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।"

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পাসপোর্ট সেবা গ্রহিতারা বলেন, অতিরিক্ত ২০০০ টাকা দিয়েছি পাসপোর্ট করার জন্য। এতে অবশ্য সুবিধা হয়েছে কোন ভোগান্তি হয় নাই।

পাশে থাকা আরেক ব্যক্তি যার বাসা মানিকগঞ্জ পৌরসভার পশ্চিম দাশড়া এলাকায় তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ১০ বছরের পাসপোর্ট করতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। পাসপোর্ট কে করে দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এক পরিচিত ব্যক্তি এই আশে পাশেই থাকে।

আরেক সেবা গ্রহীতা বলেন, আমি আবেদন করে আনসারের মাধ্যমে কিছু টাকা দিয়ে করিয়েছি। তাঁতে সিরিয়ালও তেমন লাগে নাই।

পাসপোর্ট অফিসে সড়জমিনে ঘুরে দেখার সময় অফিস গেটে পাওয়া যায়নি দায়িত্বরত আনসার সদস্য উৎপল কে। উৎপল কে দেখা যায় আবেদনপত্র নিয়ে একটি লোকের সাথে কথা বলতে।

এ বিষয়ে আনসার সদস্য উৎপল বলেন, অনেকে বুঝেন না, আমি সাহায্য করতে এগিয়ে যাই এই আর কি!

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, পাসপোর্ট অফিসে যারা সেবা নিতে আসে তারা যেনো সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে নির্বিঘ্নে সুন্দর ভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করতে পারে সেটা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও যেসব কর্মকর্তা অনিয়মের সাথে জড়িত আছে তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক অরূপ রতন চাকী বলেন, আপনি বিষয়টা বলেছেন আমি দেখবো তবে এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারবো না।

 

রাজু

×