ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

ঈদকে ঘিরে বগুড়ায় দই-মিষ্টির বাজারে বিক্রির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে

মাহফুুজ মন্ডল, বগুড়া

প্রকাশিত: ১৩:৫২, ১১ জুন ২০২৫

ঈদকে ঘিরে বগুড়ায় দই-মিষ্টির  বাজারে বিক্রির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে

ছবি: জনকণ্ঠ

ঈদ মানেই আনন্দ, আর ঈদ আনন্দে মিষ্টি খাওয়া যেন অপরিহার্য এক অনুষঙ্গ। তবে বগুড়ার বেলায় সেটা শুধু উৎসব নয়, অর্থনীতিরও বড় অংশ। দেশের জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বীকৃত খাদ্যপণ্য “বগুড়ার দই” এখন শুধু ঐতিহ্যের নয়, অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকেও বিশাল এক নাম। ২০২৩ সালের ২৬ জুন ‘জিআই’ স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই পণ্য শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে।

এই ঈদ উল আজহা ঘিরে বগুড়ার দই ও মিষ্টি বাজারে বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন ও দোকানদাররা। ঈদের আগেই টানা নয় দিনের সরকারি ছুটির সুযোগে ঘরমুখো মানুষের ঢল, বিয়ে, সুন্নতে খাৎনা, ঈদ পুনর্মিলনী, জন্মদিনসহ নানা সামাজিক আয়োজনে বেড়ে যায় দই-মিষ্টির চাহিদা। শহরের শতাধিক ও জেলায় ছড়িয়ে থাকা সহস্রাধিক দোকানে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশে বিক্রি হয়েছে এই জনপ্রিয় পণ্য।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোষ পরিবারের গৌর গোপাল পালের হাত ধরে যে দইয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর আগে, তা আজ এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাতে পরিণত হয়েছে। নবাব পরিবারের জন্য বানানো সেই "নবাববাড়ির দই" আজ সাধারণ মানুষের ঘরেও ঈদের বিশেষ পদ। বর্তমানে শেরপুর উপজেলায় ১০০টির বেশি দই-মিষ্টির শোরুম এবং জেলায় প্রায় ৮০০টির বেশি দোকান রয়েছে।

বগুড়ার দইয়ের রয়েছে নানা নাম, স্বাদ ও আকার। ঈদে চাহিদা বাড়ায় দামও বেড়ে যায়। বগুড়া এশিয়া সুইটসের জেনারেল ম্যানেজার আরিফ উজ্জামান দিপু জানান, স্পেশাল (৬৫০ গ্রাম) ওজনের দই বিক্রি করা হচ্ছে ৩০০ টাকায়, একই ওজনের শাহী দই ৩৫০ টাকা, সাদা দই (চিনিমুক্ত) ২৮০ টাকা, টকদই ২০০ টাকা, বড় ক্ষীরসা ৭০০ টাকা, ছোট ক্ষীরসা ৩৫০ টাকা। এসব দই মাটির তৈরি সরা ও হাঁড়িতে ভরে বাজারজাত করেন ব্যবসায়ীরা। তিনি আরো বলেন, বহুকাল ধরে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বগুড়ার সাদা দই। ঠাণ্ডাপানীয় খাবার হিসেবে সাদা দই অতুলনীয়। কিছু জনপ্রিয় দইয়ের ঈদকালীন বাজারদর তুলে ধরা হলো:
চিনিপাতা দই / মেজবান দই মূল্য ধরা হয়েছে ৩৬০ টাকা, স্পেশাল দই ৩৪০ টাকা, সাদা সরা দই ৩২০ টাকা, টকদই (বড়) ২০০ টাকা,  হাঁড়ি দই ৬০০ টাকা, 
টক হাঁড়ি দই ৫৫০ টাকা, ক্ষীরসা সরা দই
৭০০ টাকা,ন বোরহানি দই ২৫০০ টাকা, 
মজলিদ দই ২৬৫০ টাকা। 

ঈদের সময়ে এসব দইয়ের দাম সারা বছরের তুলনায় ৩০–১০০% পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। অনেক বিক্রেতা দুধ সংকট বা দুধের মূল্যবৃদ্ধিকে দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে দেখান, তবে ভোক্তারা এই দাম নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন।

বগুড়ার দই এখন আত্মীয়তার বন্ধনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে উপহার হিসেবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই জিআই পণ্য। দেশ-বিদেশে থাকা প্রবাসীরাও চাহিদা দিচ্ছেন, অনেকে কুরিয়ার বা বাস সার্ভিসে পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রিয়জনদের জন্য। বগুড়ার আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল বলেন, “ঈদে আমাদের দই-মিষ্টির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এবারও রেকর্ড বিক্রি হয়েছে।”

বগুড়ার নামকরা দই ও মিষ্টির দোকান এশিয়া সুইটমিট, আকবরিয়া দইঘর, চিনিপাতা দই, শেরপুর দই, শ্যামলী, মহরম দইঘর, চিনিপাতা দই, আদি মহরম, রফাত দইঘরে সবচেয়ে বেশি ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।

অর্থনীতিতে ‘দই শহর’ বগুড়ার অবদানঃ দই শুধু রসনা তৃপ্তির উপকরণ নয়, বরং বগুড়ার অর্থনীতির প্রাণ। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার দই-মিষ্টি বেচাকেনা হয় জেলার ভেতরে-বাইরে। শুধু ঈদের মৌসুমেই এর ২০ শতাংশের বেশি বিক্রি হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। বগুড়ার খ্যাতনামা দই ঘর, রফাত দই, শেরপুরের শম্পা, শ্যামলীর দই, কোয়ালিটির দই, রিংকি সুইটসের দই এর স্বত্বাধিকারীরা জানান, “ এবার ঈদে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ দই তাদের বিক্রি হয়েছে। কেবল শোরুম থেকেই বিক্রি কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।”
ঈদ উল আজহার মতো বড় ধর্মীয় উৎসব বগুড়ার জন্য শুধু সংস্কৃতির নয়, অর্থনীতিরও উৎসব। বগুড়ার দই এখন শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয়, আধুনিককালে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড। সময় এসেছে, এই জিআই পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক রপ্তানির দিকে নিয়ে যাওয়ার।

দই রপ্তানির উপযোগী প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে
জিআই পণ্য হিসেবে 'বগুড়ার দইয়ের ব্র্যান্ডিং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও জোরদার করা সম্ভব হবে বলে দই ব্যবসায়িরা জানিয়েছেন।

সাব্বির

×